।। আরতি সেন ।।
ডার্ক হিউমার আজকাল আমাদের সমাজে একটা আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। এই ধরনের ট্রোল, যা গভীর বা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মজা করে, আমাদের তরুণ প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ আমাদের সমাজে পরিবার, সম্মান আর ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব অত্যন্ত গভীর। কিন্তু এই ডার্ক হিউমার কীভাবে আমাদের সন্তানদের মন-মানসিকতাকে প্রভাবিত করছে, তা নিয়ে চিন্তা করা জরুরি। এর পাশাপাশি, এটি আমাদের সমাজের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সুন্দর মনের মানুষদেরও হাসির পাত্রে পরিণত করছে, যারা একসময় সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতেন।
ধ্রুব রাঠির একটি পর্বে, তিনি ভারতের ইন্ডিয়া’স গট লেটেন্ট নামক শো-এর একটি ঘটনার সমালোচনা করেছেন, যেখানে রণবীর আল্লাহবাদিয়া একটি অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। এই ধরনের হাস্যরস শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, বরং সমাজের গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও নীতির উপর প্রশ্ন তুলছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে সমাজ এখনও ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক সম্মানের উপর নির্ভরশীল, এই ধরনের ডার্ক হিউমার প্রভাব গভীর এবং দ্বিমুখী হতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং পিতামাতার মতো ব্যক্তিরা সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হয়। ডার্ক হিউমার যখন এই ধরনের ব্যক্তিদের নিয়ে অশোভন রসিকতা করে—যেমন রাঠির উল্লেখিত উদাহরণে পিতামাতার প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য—তখন এটি সমাজের শ্রদ্ধার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, যারা সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউবের মাধ্যমে এই ধরনের কনটেন্টে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তারা এই অসম্মানকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এটি পারিবারিক সম্পর্ক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক এবং সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ক্ষয় ঘটাতে পারে।
প্রথমত, ডার্ক হিউমার তরুণদের মনে সম্মানের ধারণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের সমাজে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একটা মূল্যবান শিক্ষা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর ইউটিউবে ছড়িয়ে থাকা এই হিউমার ভিডিও বা মিমগুলো বাবা-মা, দাদা-নানি বা বয়স্কদের নিয়ে এমন কথা বলে, যা শুনে হাসি আসার বদলে মনে হয় এটা অশ্রদ্ধা। তরুণরা এগুলো দেখে ভাবতে শুরু করে যে বড়দের নিয়ে মজা করা বা তাদের ত্রুটি নিয়ে হাসা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এর ফলে তাদের মনে শ্রদ্ধার জায়গাটা কমে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই ধরনের হাসি তরুণদের সংবেদনশীলতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। যেসব বিষয় নিয়ে আমরা আগে সিরিয়াস থাকতাম—যেমন পরিবারের সমস্যা, সমাজের দুঃখ—সেগুলো এখন তাদের কাছে হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা উদাহরণ দেই: একটি ছেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে এমন একটা ভিডিও দেখে হাসছিল, যেখানে একজন বয়স্ক মানুষের ধীরে চলার বিষয়টাকে নিয়ে মজা করা হয়েছে। এটা দেখে তার মনে কোনো সহানুভূতি জাগেনি, বরং সে এটাকে মজার বলে মেনে নিয়েছে। এই ধরনের প্রভাব তাদের মানবিক গুণাবলীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তৃতীয়ত, ডার্ক কমেডি আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা পরিবারকে কেন্দ্র করে বড় হই। আমাদের গল্পে, গানে, জীবনযাপনে পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান থাকে। কিন্তু এই কমেডির নামে যখন বাবা-মাকে নিয়ে অসম্মানজনক কথা বলা হয়, তখন তরুণরা সেটাকে “কুল” মনে করে। এর ফলে আমাদের ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি, যেটা আমাদের পরিচয়ের অংশ, তা ক্ষয়ে যাচ্ছে।
এর সঙ্গে আরেকটি বড় সমস্যা যুক্ত হয়েছে। আমাদের সমাজের লেখক, বুদ্ধিজীবী আর সুন্দর মনের মানুষেরা, যারা একসময় তাদের কলম আর চিন্তার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেন, তারাও এই ডার্ক কমেডির শিকার হচ্ছেন। তাদের গভীর চিন্তা, সমাজের জন্য তাদের পরামর্শ বা সৃজনশীল কাজকে এখন ডার্ক হিউমারের নামে ট্রোল করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের কথাকে বিকৃত করে, হাসির পাত্র বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে তাদের ইতিবাচক প্রভাব সমাজে কমে যাচ্ছে। যেখানে তারা তরুণদের সঠিক পথ দেখাতে পারতেন, সেখানে এখন তাদের কণ্ঠ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এই শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে নেতিবাচক মনের মানুষেরা। যখন বুদ্ধিজীবীদের কথা হাসির বিষয় হয়ে যায়, তখন সমাজে এমন মানুষেরা এগিয়ে আসছে, যারা অশ্রদ্ধা, বিদ্বেষ আর উদাসীনতা ছড়াচ্ছে। তারা তরুণদের মনে বিষ ঢেলে দিচ্ছে, যার ফলে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ আরও দ্রুত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এটা শুধু একটা হাসির খেলা নয়, এটা আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে।
অনেকে বলে, এটা শুধু হাসির জন্য, এতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু এই হাসি যখন আমাদের সন্তানদের মনে অশ্রদ্ধা আর উদাসীনতা জন্মায়, এবং আমাদের সুন্দর মনের মানুষদের প্রভাব কেড়ে নিয়ে নেতিবাচকতার জায়গা করে দেয়, তখন এটা আর শুধু মজার বিষয় থাকে না। এটা তাদের চিন্তাভাবনাকে বদলে দিচ্ছে। তারা এখন এমন একটা মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে, যেখানে সবকিছুই হাসির খোরাক—এমনকি যেসব বিষয় আমাদের সমাজের ভিত্তি।
এই প্রভাব থেকে বাঁচতে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তরুণদের সঠিক পথ দেখানো। তাদের বোঝাতে হবে, হাসি ভালো, কিন্তু তা যেন কারও সম্মান বা আমাদের সংস্কৃতিকে আঘাত না করে। একই সঙ্গে, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে তারা আবার সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন। ডার্ক কমেডির এই প্রভাব যদি আমরা এখন না থামাই, তাহলে আমাদের সন্তানদের মন থেকে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি আর ঐতিহ্যের জায়গা হারিয়ে যাবে, আর নেতিবাচকতা আমাদের সমাজকে গ্রাস করবে। এটা শুধু হাসির বিষয় নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষক