২৬শে মার্চ ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম পাওয়ার পর চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতাদের উদ্যোগে হাজার হাজার কপি সাইক্লোস্টাইল করে বিতরনের পাশাপাশি শহরে মাইক দিয়ে ঘোষণা চলতে থাকে। এর আগের রাত সন্ধ্যা ৭টায় নেতৃবৃন্দের কাছে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন নির্দেশনার প্রেক্ষিতে রাত ৮.৪৫ মিনিটে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের উপর আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধের সুচনা করেন ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক। একই সময় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জাফরকে দায়িত্ব দেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের বাঙালি সেনা অফিসারদেরকে যুদ্ধের সংবাদ পৌঁছে দিতে।
কিন্তু এ সংবাদ পৌঁছার আগেই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান তার অধিনায়ক কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে বন্দরের দিকে যান সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানি অস্ত্র খালাস নির্বিঘ্ন করতে। ক্যাপ্টেন রফিকের ম্যাসেজ পাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান জীপ নিয়ে ছুটে যান জিয়াউর রহমানকে আটকাতে। বন্দরের আগে ব্যারিকেডে জিয়ার গাড়ি থেমে গেলে খালেকুজ্জামান তাকে সেখানে পেয়ে যান।
যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার কথা জানান, ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। মেজর জিয়া দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার। রেজিমেন্টে ফিরে বাঙালি অফিসারদের সংঘবদ্ধ করে কর্নেল জানজুয়াসহ পাকিস্তানি অফিসারদের বন্দী করেন। তবে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে যোগাযোগ না করে রেজিমেন্টসহ চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে কালুরঘাট হয়ে পটিয়ায় গিয়ে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর বাহিনী শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব অবস্থান দখল নিতে সক্ষম হলে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্টে ও নৌবাহিনী সদস্যরা তাদের দপ্তরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতারে সম্প্রচারের। ক্যাপ্টেন রফিকও সম্মতি দেন তবে একমাত্র অফিসার হিসেবে তিনি সামরিক কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বেতারে যেতে পারবেন না বলে জানান। পরে নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শহরের কেন্দ্র আগ্রাবাদে অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতারের বদলে কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রটি ব্যবহার করা হবে।
প্রথম অধিবেশন : ২৬শে মার্চ দুপুর ১.১০ মিনিট
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, মোশাররফ হসেন, ডা. এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, আখতারুজ্জামান বাবু, ডা. আবু জাফর, মীর্জা মনসুর, ছাত্রলীগ নেতা রাখাল চন্দ্র বণিক ও শাহ-ই-জাহান চৌধুরী। কারিগরী ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরউদ্দিন, প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান ও দেলওয়ার হোসেনকে। প্রকৌশলীরা সম্প্রচারের জন্য বেতার চালু করেন।
নেতারা মিলে ঘোষণার খসড়া রচনা করেন। রাখাল বণিকের কন্ঠ প্রথম ভেসে আসে- ‘ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র, একটি বিশেষ ঘোষণা। একটু পরেই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। আপনারা যারা রেডিও খুলে বসে আছেন তারা রেডিও বন্ধ করবেন না’। এরপর এম এ হান্নান ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র বললেও পরে রাখাল বণিক স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র বলতে থাকেন। এম এ হান্নানের ঘোষণা পাঠও প্রচারিত হতে থাকে। এরপর নেতারা শহরে ফিরে আসেন। বেতার কেন্দ্রে রয়ে যান ছাত্রনেতা শাহ-ই-জাহান চৌধুরী।
দ্বিতীয় অধিবেশন : ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিট
২৬শে মার্চ সকালে ডা. শফি ও বেগম মুশতারী শফির বাসায় বসে বেতার চালু করার আলোচনা করেন চট্টগ্রামে বেতারে কর্মরত কয়েকজন- বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক প্রমুখ। তারা প্রথমে যান রাজনৈতিক নেতাদের কাছে, তারা সবাই যখন ব্যস্ত ছিলেন যুদ্ধরত ইপিআরদের সাহায্য করতে। এখান থেকে প্রখ্যাত নাট্যকার মমতাজউদ্দিন আহমদ যোগ দেন। সবাই মিলে যান আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে। একই উদ্দেশ্যে এসময় আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে হাজির হন ঐ এলাকার ডা. আনোয়ার আলীসহ কয়েকজন। ডা. আলীর কাছে ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার কপি।
আগ্রাবাদ কেন্দ্রের আঞ্চলিক প্রকৌশলী কাহহার পরামর্শ দেন কালুরঘাট যেতে। পরামর্শ অনুযায়ী সবাই মিলে কালুরঘাট পৌঁছান। এখানে প্রথম ঘোষণা দেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ। সংবাদ পাঠ করেন সুলতান উল আলম। সন্ধ্যার পর ডা. জাফর ও এম এ হান্নান আবার আসলে বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে এম এ হান্নান আবার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
তৃতীয় অধিবেশন : ২৬শে মার্চ রাত ১০টা
মাহমুদ হোসেন, ফারুক চৌধুরী (আগ্রাবাদ হোটেলের সহকারী ম্যানেজার), বেতার শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী রাত ১০টায় বেতার চালু করেন।
চতুর্থ অধিবেশন : ২৭শে মার্চ সকাল ১০.৩০ মিনিট
এই অধিবেশনটি পরিচালনা করেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের সাথে বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ এবং কথিকা পাঠ করা হয়।
পঞ্চম অধিবেশন : ২৭শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা – বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার ঘোষণা পাঠ
এদিন সকাল বেলা বেলাল মোহাম্মদ পটিয়ায় গিয়ে মেজর জিয়াকে অনুরোধ করেন, বেতার ভবনের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। মেজর জিয়া তৎক্ষণাৎ কয়েকজন সৈন্য পাঠিয়ে দেন। তিনি নিজে বেতার কেন্দ্রে আসেন বিকেল ৫টায়। বেলাল মোহাম্মদের সাথে অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদও ছিলেন। তারা মেজর জিয়াকে অনুরোধ করেন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে। মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
যষ্ঠ অধিবেশন: ২৭শে মার্চ রাত ৯.৩০ মিনিট- মেজর জিয়ার নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা
মেজর জিয়া হঠাৎ করেই আবার বেতারে আসেন রাত ৯.৩০ মিনিটে তার সামরিক অফিসারদের নিয়ে। আবার বেতার চালু হয়। আমিনুর রহমান ও আবদুস শুকুর নামে দুজন বেতার কর্মী ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না তখন। এবারের ভাষণে মেজর জিয়া নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন।
সপ্তম অধিবেশন : ২৮শে মার্চ সকাল ৯টার পর
এই অধিবেশনে বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সেকান্দর হায়াত খান, ল্যাফটেনেন্ট শমসের মবিন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। মেজর জিয়ার নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণাটি পুনঃ প্রচার হয়। দিনের বেলা সম্প্রচারে এই ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এম এ হান্নানের নির্দেশে চট্টগ্রাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাবের আহমদ আসগরী এসে মেজর জিয়াকে জানান- অবিলম্বে ঘোষণা বদলাতে হবে, না হলে সংগ্রাম পরিষদ অন্য কোন সেনা অফিসার দিয়ে নতুন করে ঘোষণা দেয়াবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে জিয়া বেতার কেন্দ্রে যান।
অষ্টম অধিবেশন : ২৮শে মার্চ দুপুর ২টার পর
এই অধিবেশনে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আবারো স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করে বিভ্রান্তির অবসান ঘটান। এরপর থেকে এই ঘোষণাটি বারবার প্রচার হতে থাকে।
কালুরঘাট থেকে মোট ১৪টি অধিবেশনে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। ৩০ মার্চ বেতার কেন্দ্র লক্ষ্য করে পাকিস্তানিরা বিমান আক্রমণ করলে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ৩১শে মার্চ ট্রান্সমিটারটি খুলে পটিয়া, বান্দরবন, রামগড় ঘুরে বিএসএফ এর সহযোগীতায় ৮ এপ্রিল বিলোনিয়ার এক পাহাড়ে ট্রান্সমিটারটি আবার চালু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অগনিত ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের পাঁচ দিনের সম্প্রচারও উল্লেখযোগ্য। তবে মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর জলিল সহ গুরুত্বপুর্ণ বাঙালি সামরিক অফিসারগণ নিজ দায়িত্বেই ২৫ থেকে ২৭শে মার্চের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বে চলে আসেন।
বেতার কেন্দ্র ঘিরে যখন এসব চলছে তখনো ৫ কি.মি. দূরে চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন রফিক।
সুত্রঃ
===
১। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খন্ড। ১৯৭৭।
২। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। ১৯৮১
৩। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। প্রফেসর ডা. এম সুলতান উল আলম। ২০১১
৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বেলাল মোহাম্মদ।
৫। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। ডা. মাহফুজুর রহমান। ২০১৪
(বিডি ডাইজেস্ট প্রতিবেদন। ২৭ মার্চ ২০২৫)