জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের কোথাও কোনো অপরাধ, চাঁদাবাজি, দখলদারি কমেনি, বরং বেড়েছে শত গুণে। নতুন নতুন খাত এবং মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ৫ই আগস্টের পর খুলনার নৌপরিবহন মালিকদের কার্যকরী কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করেন ব্যবসায়ীরা। গত চার মাসে এই অ্যাডহক কমিটি নিয়ে কোনো বিরোধ বা আপত্তি প্রকাশ পায়নি। হঠাৎ গত রোববার “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র” পরিচয়ে একদল যুবক হঠাৎ উপস্থিত হয়ে এই কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করে দিয়ে যায়।
১০ই নভেম্বর খুলনার বেসরকারি সবুরুণনেছা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করে একদল তরুণ, যারা নিজেদের “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী” বলে পরিচয় দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করা। সেদিন ওই সময় অধ্যক্ষ কলেজে অনুপস্থিত ছিলেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন তারা সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে অধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়। দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও সেই তালা খোলা হয়নি। ফলে, কলেজের ১৭টি ল্যাপটপ এবং গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসও বন্ধ হয়ে গেছে।
শুধু এই দুটি প্রতিষ্ঠান নয়, সম্প্রতি উদ্দেশ্যমূলকভাবে উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অচল করার নজির বাড়ছে। গত তিন মাসে মোংলা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, খুলনা ক্লাব, খুলনা চেম্বার অব কমার্স এবং নৌপরিবহন মালিক গ্রুপসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কমিটি এভাবেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলরা আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ অজুহাতে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ৫ই আগস্টের পর বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত সংগঠক বা আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ধারী লোকজন সংগঠনের দখল নিয়েছেন।
‘মবোক্রেসি’ নামে সংঘদ্ধ আক্রমণে প্রকাশ্য দিবালোকে আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে, বিচারের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে মানুষ হত্যার যে ধারা চালু হয়েছে ৫ই আগস্টের পর, এর প্রেক্ষিতে কেউ প্রতিবাদ কিংবা বাধা দেওয়ার চিন্তাও করে না এখন। ফলে জোর যার মুল্লুক তার- পরিস্থিতি বিরাজ করছে সর্বত্র।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে, একটি নির্দিষ্ট পক্ষ শিক্ষার্থী ও তরুণদের সাথে নিয়ে মবোক্রেসি চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ লেনদেন, হত্যা না করার নিশ্চয়তা দিয়ে চাঁদাবাজি, মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, চেম্বার অব কমার্সের কমিটি ভাঙার সময় ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে মুরগি বিক্রেতা ও টোকাইদের নিয়ে মব তৈরি করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। একইভাবে, খুলনা ক্লাবে পছন্দের ব্যক্তিদের চেয়ারে বসানো এবং টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব।
যদিও খুলনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র প্রতিনিধিরা এই কার্যক্রমের বিরোধিতা করেছেন। তারা একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা মব তৈরি (যুবকদের একত্রিত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি) থেকে বিরত থাকে এবং কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন দখলে অংশগ্রহণ না করে।
নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের ক্ষেত্রে জানা যায়, নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু আদালতের আদেশে সেই নির্বাচন স্থগিত হয়। এরপর থেকেই সংগঠনটি দখলের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব কাজী ইমাম হোসেন বাদশা মন্তব্য করেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত। যে যেভাবে পারে, সমিতি নিয়ে নিলে আমরা বাঁচি।’
গত ৪ঠা অক্টোবর শহীদের পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনায় সিঅ্যান্ডএফ ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্ররা। তাদের দাবির মুখে ব্যবসায়ীরা আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে সংগঠনের উপদেষ্টা ও নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনিকে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যের একটি নতুন কমিটি গঠন করেন। তবে এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিএনপি-সমর্থিত ব্যবসায়ীদের অন্য একটি দল মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক এবং মহানগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ইশতির ভাই জনিকে সদস্য সচিব করে আরেকটি কমিটি গঠন করে।
২০শে নভেম্বর ছাত্রদের একটি অংশ মোশাররফ-জনি সমর্থিত কমিটির পক্ষে গিয়ে তাদের ভবনে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসে। তবে, কর্মচারী এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার মুখে তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ফলে সংগঠনে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
একই চিত্র সারাদেশে। জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, ছাত্র সমন্বয়ক বা বিএনপি, জামায়াত বা শিবিরের রাজনৈতিক পরিচয়ে চলছে চাঁদাবাজি, দখলদারির ঘটনা। আবাসিক হোটেলে অনৈতিক কাজ চলছে, কারখানায় ঠিকমত কাজ চলছে কি না, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা রিসোর্টে আওয়ামী লীগের লোকজন লূকিয়ে আছে, – এমন নানা অজুহাতে গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অননুমোদিত পরিদর্শনে হাজির হয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে অনেক জায়গায় পিটুনিও খেয়েছেন আন্দোলনকারী বা সমন্বয়করা। তবুও তাদের মবোক্রেসি থামছেই না।
৪ঠা আগস্ট থেকে ৮ই আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে সাড়ে ৪শর বেশি থানার অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে। এসব অবৈধ অস্ত্র আন্দোলনকারীদের অনেকের হাতে রয়েছে বলে অভিযোগ। এসব অস্ত্র প্রদর্শন করে হুমকি-ধমকি বা কখনো সরাসরি অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। তাদের হাতে সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্র জিম্মি। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে চান সাধারণ মানুষ।