।। তাসিন মেহদি।।
ভয়াবহতা ও ট্র্যাজেডির এক রাত। ১৯৭১ সালের এই রাতে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা চালায়। শুধুমাত্র ঢাকাতেই এক রাতে পাঁচ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়কালে প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ প্রাণ নৃশংসভাবে কেড়ে নেওয়া হয়। এছাড়া, আনুমানিক ২,৫০,০০০ নারী অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হন, তাদের মর্যাদা এবং আত্মসম্মান হারান। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডগুলো জাতির উপর গভীর ক্ষতের চিহ্ন রেখে গেছে, যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অকল্পনীয় বেদনা ও কষ্টের একটি সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
কিন্তু ২০২৫ সালে, রাষ্ট্র সেই কুখ্যাত “অপারেশন সার্চলাইট”-এর অন্যতম স্থপতি মেজর ইকরাম সেহগালকে স্বাগত জানিয়েছে। এটি শুধু জাতীয় অপমান নয়; এটি আমাদের ইতিহাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। সেহগাল, যিনি অস্ত্র পরিবহন করেছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নির্যাতন চালাতে সরাসরি সহায়তা করেছিলেন, ১৭ বছর পর আবার বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছেন।

চিত্র: মেজর ইকরাম সেহগাল।
তাকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে তা-ই নয়, তাকে বিলাসবহুলভাবে সম্মানিত করা হয়েছে, প্রশংসা করা হয়েছে এবং এমনকি আনুষ্ঠানিক গার্ড অফ অনারও দেওয়া হয়েছে। আমাদের সেই সেনাবাহিনী, যা আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের উপর নির্মিত, যারা আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তারাই তাকে স্বাগত জানিয়েছে। এটি কূটনীতি নয় — এটি আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের গভীর লঙ্ঘন এবং মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের সাথে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।
তার নিজের বই এস্কেপ ফ্রম ওব্লিভিয়ন-এ ইকরাম সেহগাল খোলাখুলিভাবে এবং তীব্রভাবে বাংলাদেশ এবং এর সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি এমনকি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “অপারেশন সার্চলাইট ছিল একটি পেশাদারভাবে পরিচালিত সঠিক সামরিক পদক্ষেপ।” এই বক্তব্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের মূলের উপর আঘাত, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যে রক্ত ও ত্যাগ দেওয়া হয়েছিল, তার প্রতি অপমান।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য মুছে ফেলার একটি কুটিল ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, আমাদের জাতির কঠিন লড়াইয়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক স্বাধীনতা জাদুঘর ৫ তারিখে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ইচ্ছাকৃত কাজ শুধু একটি ভৌত কাঠামোর উপর আক্রমণ নয়, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বাঙালি হওয়ার মূল সারাংশের উপর সরাসরি আঘাত।
আশ্চর্যজনকভাবে, আট মাসের দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও, সরকার এই পবিত্র স্থানটি পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ দেখায়নি, যা স্বাধীনতা জাদুঘরের প্রতি তাদের উদ্বেগজনক এবং বিষাক্ত উদাসীনতা প্রমাণ করে। এই জাদুঘরটি কেবল একটি ভবন নয় — এটি আমাদের পরিচয়ের একটি ভিত্তিপ্রস্তর, অসংখ্য দেশপ্রেমিকের ত্যাগের প্রতিফলন। সরকারের অবহেলা আমাদের ইতিহাস সংরক্ষণের প্রতি বিপজ্জনক উদাসীনতা প্রকাশ করে, যা আমাদের প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে যে, তারা কি সত্যিই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের গুরুত্ব বোঝে?
ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লালমনিরহাটে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসর্গিত ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ম্যুরালটি তথাকথিত জুলাই বিপ্লবের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা জনগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই বিতর্কিত পদক্ষেপ বর্তমানে ইতিহাস কীভাবে উপস্থাপিত ও ব্যাখ্যা করা হয়, তা নিয়ে গভীর সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে। জাতীয় গর্ব ও ত্যাগের প্রতীককে অস্পষ্ট করে, এটি বিভিন্ন আখ্যানের মধ্যে উত্তেজনা এবং মূল ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর চিত্রণ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে তুলে ধরে।
স্বাধীনতা দিবসে, পাবনা জেলা প্রশাসন এই উপলক্ষে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে বিএনপি-র নেতা একটি উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেন, যা উপস্থিতদের গভীরভাবে অস্থির করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তিনি দাবি করেন যে, ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা লড়েছিলেন, তাঁরা আসলে ফ্যাসিবাদের মিত্র ছিলেন। আরও খারাপভাবে, তিনি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি বলে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। এই বক্তব্যগুলো, যা দেশের ইতিহাসের ভিত্তি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে চ্যালেঞ্জ করে, তাঁদের মধ্যে তীব্র এবং ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভের জন্ম দেয়।
চিত্র: পাবনা জেলা বিএনপি-র সদস্য সচিব মাসুদ খন্দকারের বক্তব্যের প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধারা। বুধবার বিকেলে, জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে।
উপসংহারে, আমরা কীভাবে এই সত্যের সাথে মিল করব যে, ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে ভেজা একটি জাতি, অকল্পনীয় কষ্ট ও ত্যাগের মাধ্যমে গড়া এই ভূমি, এখন শুধু এই ব্যক্তিকে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না, বরং তাকে সক্রিয়ভাবে স্বাগত জানাচ্ছে, একই সঙ্গে ১৯৭১-এর নৃশংসতাকে আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে? এটি আমাদের জাতি হিসেবে কী বলে? এটি আমাদের ইতিহাস, সম্মান, পরিচয় এবং যে আদর্শের জন্য আমরা লড়েছিলাম, সে সম্পর্কে বিশ্বের কাছে কী বার্তা দেয়?
অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে: এই লজ্জাজনক আমন্ত্রণের মাধ্যমে আপনারা এই দেশের জনগণের কাছে কী বার্তা দিচ্ছেন? আমাদের শহীদদের অপরিমেয় ত্যাগ, আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি, তার প্রতি কি আপনারা এত সহজে পিঠ ফিরাতে প্রস্তুত? যদি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি, আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে সত্য মুছে ফেলা, স্মৃতিসৌধ ধ্বংস করা, নব্য-রাজাকারদের পুনর্বাসন এবং এখন আমাদের নিপীড়কদের সহায়তাকারীদের স্বাগত জানানো এই জাতির নীতি হয়ে ওঠে, তবে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী হচ্ছি — আমাদের স্বাধীনতার জন্য যে রক্ত, ঘাম এবং অশ্রু ঝরানো হয়েছিল, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
ইকরাম সেহগালের বাংলাদেশে আগমন কেবল একটি কূটনৈতিক অঙ্গভঙ্গি নয় — এটি আমাদের পরিচয়ের উপর নির্মম আক্রমণ, আমাদের জাতীয়তার মূল সারাংশের উপর আঘাত। তাকে আমাদের মাটিতে পা রাখতে দেওয়া শুধু ক্ষমার অযোগ্য অপমান নয় — এটি আমাদের সংগ্রামের পবিত্রতাকে হ্রাস করার, যাঁরা আমাদের উপভোগ করা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতিকে কলঙ্কিত করার একটি ইচ্ছাকৃত কাজ। প্রতিটি বাঙালি, যিনি ১৯৭১-এর স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করেন, প্রতিটি আত্মা, যিনি আমাদের স্বাধীনতার ন্যায়পরায়ণতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের এই অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উঠতে হবে।
এটি শুধু একজন ব্যক্তির বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের আত্মার বিষয়। ১৯৭১-এর ক্ষতগুলো এখনও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গভীরভাবে বিদ্যমান, এবং আমরা পারি না, আমাদের অবশ্যই এই ক্ষতগুলোকে পুনরায় খুলতে এবং যাঁরা আমাদের কষ্টের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেন না, তাঁদের দ্বারা উপহাস করতে দেওয়া উচিত নয়। আমাদের শহীদদের, আমাদের পূর্বপুরুষদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের ঋণ রয়েছে, যাতে এই বিশ্বাসঘাতকতা অপ্রতিহত না হয়।
এখন আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব, একটি জাতি এবং ব্যক্তি হিসেবে, এই ব্যক্তি এবং তিনি যে মিথ্যার প্রতিনিধিত্ব করেন, তা আমাদের ইতিহাসে দাগ না ফেলে তা নিশ্চিত করা। “শত্রু মিত্রে পরিণত হয়েছে” — এমন একটি দাগ ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না, এবং আমাদেরও তা অপ্রতিহত রাখতে দেওয়া উচিত নয়।