“ভারত গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ দেখতে আগ্রহী।”
বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে এ অঞ্চলের জন্য প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করছে ভারত। নিজের সীমান্ত সুরক্ষায় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে গঠনমূলক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে নয়াদিল্লি।
ভারত বলছে, গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ইসলামি উগ্রবাদীদের অব্যাহত মুক্তির ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য ‘মারাত্মক উদ্বেগের’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে ২৬ মার্চ ভারতের লোকসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকে ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি ’ব্যাকগ্রাউন্ড নোট’ উপস্থাপন করা হয় যেখানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় ছাড়াও ‘কট্টরপন্থার উত্থান’, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা’ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতে এ বৈঠকের দিনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে চীনে যান।
এরইমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের যে প্রস্তাব ঢাকা দিয়েছিল, তাতে নয়াদিল্লির সাড়া মেলেনি বলে খবরও এসেছে।
আগামী ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সাত দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক জোট বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে ইউনূস ও মোদীর দেখা হবে।
মোদীর সফরসূচি নিয়ে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সূচি রাখা হয়নি।
বাংলাদেশে ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ‘উদ্বেগের একটা বড় জায়গাজুড়ে’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন দেশটির গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড।
ভারত সফরকালে ১৭ মার্চ সে দেশের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথোপথেনের সময় ‘ইসলামি খিলাফত’ নিয়ে কথা বলেন তিনি।
তুলসী গ্যাবার্ড বলেছিলেন, “চরম ইসলামপন্থিদের হুমকি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক যে প্রচেষ্টা, তাদের সবার শিকড় একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে মিশেছে। তাদের সে উদ্দেশ্য হল ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা।”
তুলসী গ্যাবার্ডের এ বক্তব্যের পর ১৯ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে দেশে আবার গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এবার ভারতের পররাষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকের ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নোট’ এও বিষয়টি উঠে এল।
ওই নোটে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সে অনুযায়ী, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্য দলগুলো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
“তবে নির্বাচনের আগে সংস্কারের সময়সীমা অস্পষ্টই রয়ে গেছে। অন্যদিকে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর বড় দলগুলোর ‘চাপ’ বাড়ছে।”
ভারতের পররাষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ব্যাকগ্রাউন্ড নোটে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি অপরাধ, সম্পত্তি ভাঙচুর, ‘মব’ তৈরি করে বেআইনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির খবর নিয়মিতই হচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে এসব ঘটনায় সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের দলাদলি ও দ্বন্দ্ব দেশের জন্য হুমকি।
“রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে জনপরিসরে উগ্রবাদী গোষ্ঠিগুলোর ধর্মীয় বিষয় টেনে আনার ঘটনা বাড়ার কথা তুলে ধরে সেখানে বলা হয়েছে, এই গোষ্ঠিগুলো ‘ইসলামি খিলাফত’ এর আদর্শ লালন করে।”
এতে বলা হয়, ১২ মার্চ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ধর্মীয়, জাতিগত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর এখনো হামলার ঘটনা ঘটছে। ২০২৪ সালের ৪ অগাস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে মোট ২ হাজার ১৮৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গত বছর ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকে তিনি সেখানেই আছেন।
এর মধ্যেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো নিপীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একাধিক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
সম্প্রতি বেশ কিছু অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ার খবর তুমুল আলোচনা তৈরি করলেও যারা এসব বন্ধ করছেন, সেই পেছনের মানুষগুলো রয়ে যাচ্ছেন আলোচনার বাইরে।
সম্প্রতি বেশ কিছু অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ার খবর তুমুল আলোচনা তৈরি করলেও যারা এসব বন্ধ করছেন, সেই পেছনের মানুষগুলো রয়ে যাচ্ছেন আলোচনার বাইরে।
প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর ভারত সরকারকে ‘কূটনৈতিকপত্র’ পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ভারত এখনও কোনো জবাব দেয়নি।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। দিল্লিতে বসে তিনি বাংলাদেশকে ‘অস্থিতিশীল করার চেষ্টা’ করছেন বলে অভিযোগ এনেছে ইউনূস সরকার।
পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ প্রচারের অভিযোগ করে আসছে বাংলাদেশ সরকার।
অপরদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ভারত সরকার।
বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত সমস্যা এবং শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে কূটনীতিক তলবের পাল্টাপাল্টি ঘটনাও ঘটেছে।
তবে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিবাচক বিষয়গুলোও ভারতের লোকসভার স্থায়ী কমিটির ব্যাকগ্রাউন্ড নোটে এসেছে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি, ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশে প্রকল্পগুলোর কাজ পুনরায় শুরু হওয়া, ফরেন অফিস কনসালটেশন, গঙ্গা চুক্তি বিষয়ে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক, বিএসএফ-বিজিবি মহাপরিচালক বৈঠকসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও সহযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছে সেখানে।
এছাড়া দুই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর পর্যায়ে একাধিক বৈঠকের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে এ নোটে।
সেখানে শুরুতেই বলা হয়েছে, “২০২৪ সালের অগাস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পারস্পরিক স্বার্থ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিক সম্পর্ক কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত গঠনমূলক সম্পৃক্ততা বজায় রেখে আসছে। ভারত গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ দেখতে আগ্রহী। তারা চায় জনকেন্দ্রিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।”
হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে ভারতের প্রত্যাশার কথা বাংলাদেশকে জানানো এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে বার বার তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে সেই নোটে।
এতে বলা হয়েছে, বার বার বিষয়টি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তোলা হয়েছে। ২০২৪ সালে ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের তরফে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ৮৮ ঘটনায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য দেওয়া হয়। ভারত সরকার ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে বার বার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার সংখ্যালঘুদের ‘পদ্ধতিগত নিপীড়নের’ কথা শুধু অস্বীকারই করেনি ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে হিন্দুদের ওপর সহিংসতার মাত্রা ও ধরনকে গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ও অন্য উপদেষ্টারা সংখ্যালঘুদের প্রতি নৃশংসতাকে সংবাদমাধ্যমের অতিরঞ্জন হিসেবে দাবি করেছে। এগুলোকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা হিসেবে স্বীকার না করে আওয়ামী লীগ করার কারণে ‘রাজনৈতিক রোষে হত্যার শিকার’ বলে ‘ন্যায্যতা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।