গত দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের কারো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় মার্কেট কিংবা বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজির অপবাদ ছিল আওয়ামী লীগ কর্মীদের ঘাড়ে। আরও অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির একটি অংশ পুলিশের পকেটেও যায়।
গত বছরের ৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সহিসংতা, নৃশংসতা, বর্বরতায় পর্যুদস্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজনীতির মাঠছাড়া। হাজার হাজার নেতাকর্মী শহিদ হয়েছেন প্রতিপক্ষের নৃশংস হামলায়, অন্তত ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী আছেন কারাগারে। পুলিশের কয়েক হাজার সদস্যের কোনো খোঁজ নেই, নৃশংসতার শিকার হয়েছেন তারাও। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের লোক দিয়ে নতুনভাবে পদায়ন করেছে শূন্য পদগুলোতে।
কিন্তু পত্রিকার পাতা ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, চাঁদাবাজি বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণে। কারা করছে এই চাঁদাবাজি? আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কি নিষ্কৃতি মিলছে?
গণমাধ্যমের খবরে প্রায়ই দেখা যায়, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জিম্মি করে অর্থ আদায়সহ নানা অপকর্মে বিএনপির নেতাকর্মীরা ধরা পড়ছেন। বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে দলকে। গত আট মাসে বিএনপি দেড় হাজারের নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে। চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় দলটি।
পিছিয়ে নেই তাদের সাবেক দোসর জামায়াতে ইসলামীও। যুদ্ধাপরাধী এই দলটির গুপ্ত সংগঠন ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি না করলেও জিম্মি করে, রাজনৈতিক ও মিথ্যা মামলায় আসামি হিসেবে ঢুকিয়ে পরে নাম প্রত্যাহারের নামে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজিতে যুক্ত। বিএনপির কর্মীরা যেখানে ছোটখাট চাঁদাবাজিতে লিপ্ত, জামায়াত-শিবির যুক্ত লাখে-কোটি টাকার ধান্দাবাজিতে।
জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলনে জঙ্গি হামলায় সম্পৃক্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র (বৈছা) আন্দোলনের নেতারা রীতিমত টেক্কা দিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত কর্মীদেরও। সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে সরকারে-প্রশাসনে নিয়োগ বাণিজ্য করে একেকজন আঙুল ফুলে বটগাছে পরিণত হয়েছেন। আন্দোলনকারীরা নাগরিক কমিটি, নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনে বিভক্ত হয়েছে যত বেশি, তাদের চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজি বেড়েছে ততটাই বেশি।
শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন একেকজন। নিজ নিজ এলাকায় গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউন করছেন এখন তারা। আর্থিক উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সুস্পষ্ট জবাব নেই কারো কাছে।
চাঁদাবাজির ধরন এখন
সাবেকি আমল ও বর্তমানের চাঁদাবাজির ধরনের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, “আগে চাঁদা দেয়া লাগত একজনরে, এখন দিতে হয় চার-পাঁচজনরে। আননোন (অপরিচিত) নম্বর থেইকা ফোন আসলেই ভয় লাগে। আবার কে জানি টাকা চায়! না দিয়াও উপায় নাই, নইলে লাশ পইড়া থাকব আগানে-বাগানে, রাস্তায়।”
কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থাকার পরও মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই ব্যবসায়ী। যারা চাঁদা নিয়েছেন, তারা বিএনপির বলেই তার অভিযোগ।
পথে পথে চাঁদাবাজি আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান যশোর থেকে তরি-তরকারির ট্রাক নিয়ে ঢাকায় আসা ট্রাকচালক মোজাম্মেল। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতে পথে তাকে ৪টি স্পটে চাঁদা দিতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যশোর থেকে নড়াইলে হয়া ফরিদপুর, ঢাকার যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতে ৫০-১০০ করে ৪ স্পটে চাঁন্দা দিয়া লাগে। কারওয়ান বাজারে গিয়ে গাড়ি রাখতে দিতে হয় আরও ২০০ টাকা।
মোজাম্মেল বলেন, “কত কিছু বদলাচ্ছে শুনতিছি। কই চাঁন্দাবাজি তো বন্ধ হয়নি! আমরা তো দেখতিছি, চাঁন্দাবাজি আরও বাড়ছে।”
তরি-তরকারি নিয়ে আসা আরেক ট্রাকচালক সিদ্দিকও বলেন, “আমাদের দিন বদলায় না। ক্ষমতা বদলাইছে কিন্তু চাঁদাবাজি থেকে গেছে। আগের চেয়েও স্পট বাড়ছে এখন।”
পুলিশকে টাকা দিতে হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান দুই ট্রাকচালকই।
গত বছরের ৫ই আগস্টের পর সপ্তাহখানেক কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। তবে এখন চাঁদাবাজি রমরমা। স্পট ভাগাভাগি হয়ে গেছে। কেউ কারো স্পটে বখরাবাজি করে না বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
এক আড়তদার বলেন, “শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ের কিছুদিন যাইতে না যাইতেই চাঁদাবাজি শুরু। কেউ আইয়া কয় যুবদল, কেউ ছাত্রদল। আরও আছে শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল। কেউ আবার জামাতি শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন। একেক সময় একেক গ্রুপ। কয়জনরে টাকা দিমু? ওগো জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ।”
গুলিস্তান মোড় এবং এর আশপাশের সড়কের ফুটপাত দখল করে থাকা হকারদেরও চাঁদা দিতে হচ্ছে।
শিশুদের কাপড় বিক্রি করেন শরীয়তপুরের মোহাম্মদ হানিফ। তিনি বলেন, “টাকা ছাড়া কেউ এখানে বসতে পারে? ভাবছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে এখন আর চান্দাফান্দা দেওয়া লাগব না। এক সপ্তাহ পর ভুল ভাঙছে। চান্দাবাজরা বইলা গেছে টাকা না দিলে জায়গা ছাড়তে হইব।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চান্দাবাজি শুরু হয়েছে। একেকজন হকারকে ১ লাখ টাকা দিয়ে বসতে হয় বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, “আমার কাছে মাসে ৯ হাজার টাকা ভাড়া চাইছে। আমি দিতে পারি নাই, পরে আমারে মারধর কইরা দোকান তুইলা দিছে।”
কারা টাকা তুলছে জানতে চাইলে অনেকে মুখ খুলতে চাননি। তবে নাম-ধাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানালেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা টাকা তুলছেন। আবার অন্য স্পটে তুলছেন জামায়াতের শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।
উল্লেখ্য, গত কয়েক মাসে ফেনীতে জামায়াতে ইসলামীর জেলা পর্যায়ের এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বৈছা নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।
রংপুরে নাহিদ হাসান খন্দকার নামে এক নেতার চাঁদা দাবির ভিডিও এবং অডিও সোশাল মিডিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতার পিতার কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছিলেন এক বৈছা নেতা, তার ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে না, এমন নিশ্চয়তা দিয়ে চাঁদাবাজি করছিলেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বালুমহাল দখল, নির্মাণ কাজে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতাকর্মীর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে গত কয়েক মাসে।
পরিবহন খাতেও চাঁদাবাজি চলছে রমরমা। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে এই চাঁদা আগে নেওয়া হত, এখনও নেওয়া হয়। শুধু সংগঠনগুলোর নেতা বদলে গেছে। এখন দাপুটে অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন। এই খাতের চাঁদাবাজির প্রায় পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে সংগঠনটি।
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি বাসকে চাঁদা দিতে হয় ৫২০ টাকা। প্রকাশ্যেই নেওয়া হয় সেই চাঁদা। ঢাকা শহরে বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে দৈনিক গড়ে ২ কোটি টাকার ওপরে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
চাঁদা আদায়কারী একজন দম্ভোক্তির সুরে বলেন, “এইডাই এখানকার সিস্টেম। গাড়ি ছাড়ার আগে এই টাকা দিতে হয়। মালিক সমিতির নির্দেশেই এইডা তোলা হয়।”
ঢাকায় বাস টার্মিনালে মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে মূলত চাঁদা নেওয়া হয়ে থাকে। সেগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।
আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, সভাপতি ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা।
গত বছরের ৫ই আগস্টের পর ইস্কাটনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপি নেতারা। সভাপতি হয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাজী আলাউদ্দিন। মহাসচিব হয়েছেন কুমিল্লা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। তিনি আবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক। সেখানে সভাপতি বিএনপি নেতা এম এ বাতেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিএনপির আব্দুর রহিম বক্স। সাধারণ সম্পাদক বিএনপির আরেক নেতা হুমায়ুন কবির খান।
বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বশির হাওলাদার। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মোহাম্মদ আলমগীর। দুজনই বিএনপির নেতা।
তেজগাঁও এলাকার ট্রাক স্ট্যান্ডেও প্রতিটি গাড়ি থেকে ১৪০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এর ১০০ টাকা নিচ্ছে ট্রাক-কভার্ডভ্যান মালিক সমিতি। ২০ টাকা নিচ্ছে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। প্রহরীদের বেতন বাবদ নেওয়া হচ্ছে বাকি ২০ টাকা। মহাখালীর পাশাপাশি গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালেও বাস ঢোকানো এবং বের করার সময় চাঁদা দিতে হয়। বাস মালিকদের দুই সংগঠনের নেতাদের সম্মতিতেই চাঁদার হার নির্ধারণ হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
এর বাইরে, যেকোনো রুটে নতুন বাস নামানোর সময় মালিক সমিতিকে এককালীন মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। জেলা বা স্থানীয় মালিক সমিতিকেও দিতে হয় চাঁদা।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, কেবল ঢাকা শহরের অবস্থিত অর্ধশতাধিক পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।
অভিযোগ অস্বীকার
মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করছে। তাদের দাবি, চাঁদাবাজি সব অভিযোগ ভুয়া। এখন কোনো চাঁদাবাজি হয় না।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বাতেন বলেন, “আগে সমিতির নামে চাঁদা উঠাইতো বিভিন্ন জায়গায়। আমরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।”
টার্মিনালগুলোতে বাসপ্রতি এখন যে টাকা নেওয়া হচ্ছে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা চাঁদা না, এটা হলো পরিচালনা ব্যয়। অফিস ভাড়া, বেতন, টিকেট, কর্মচারী ইত্যাদি খরচের জন্য কোম্পানিগুলো এটা তোলে। এই খাতে আমরা বাসপ্রতি মাত্র ৩০০-৩৫০ টাকা নিচ্ছি।”
ট্রাক-কভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভপতি তোফায়েল হোসেন মজুমদারও বলেন, “ট্রাকস্ট্যান্ডের উন্নয়ন কাজে যে খরচ হয়েছে, তার জন্য ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। বাকিটা সংগঠনের কাজে ও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।”
দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পরিবহন খাতে দখলদারির অভিযোগ অস্বীকার করছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির দলীয় কার্যলয় সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকে গত ৮ মাসে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দেড় হাজার নেতাকর্মী বহিষ্কৃত হয়েছেন। চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের সত্যতা মেলায় ১২টিরও বেশি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।