২৮ মার্চ ছিল কিংবদন্তি বিপ্লবী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সত্যেন সেনের জন্মদিন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, শ্রমিক সংগঠক এবং বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা।
১৯০৭ সালের ২৮শে মার্চ, বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সত্যেন সেন। তাঁর পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য এবং আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল লস্কর।
সত্যেন সেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিকভাবে, পরে তিনি সোনারং হাই স্কুলে ভর্তি হন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২৪ সালে কলকাতায় কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথমবার কারাবরণ করেন। এরপর ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হলে ছয় বছর কারাভোগ করতে হয়। জেলে থাকাকালীন বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত সত্যেন সেন ছিলেন শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ‘কৃষক সমিতি’র মাধ্যমে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দমননীতি মোকাবিলায় সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সহযোগিতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ সময় তাঁর চোখের গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে মস্কোতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংবাদ শুনে আবেগাপ্লুত হন।
১৯৬৮ সালে তিনি রণেশ দাশগুপ্ত ও শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। উদীচী শুধু সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়, এটি ছিল গণসংগ্রামের প্রতীক। তাঁর রচিত গণসংগীত, কবিতা ও নাটক সংগ্রামের চেতনা জাগিয়ে তুলেছে শ্রমিক-কৃষকদের।
সত্যেন সেন বাংলা সাহিত্যে এক শক্তিশালী বিপ্লবী কণ্ঠস্বর। তাঁর রচিত ভোরের বিহঙ্গী, রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ, অভিশপ্ত নগরী, পাপের সন্তান, সেয়ান, পদচিহ্ন, পুরুষমেধ, আলবেরুনী, সাত নম্বর ওয়ার্ড, বিদ্রোহী কৈবর্ত, কুমারজীব, অপারেজয়, মা, উত্তরণ এবং একুল ভাঙে ওকুল গড়ে উপন্যাসগুলো বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইতিহাসনির্ভর সাহিত্যেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছেন, যার মধ্যে গ্রামবাংলার পথে পথে, আমাদের পৃথিবী, মসলার যুদ্ধ, এটোমের কথা, অভিযাত্রী, মানবসভ্যতার উষালগ্ন, মনোরমা মাসিমা, প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ, বিপ্লবী রহমান মাস্টার এবং সীমান্ত সূর্য আবদুল গাফফার উল্লেখযোগ্য। শিশুদের জন্যও তিনি বেশ কিছু গল্প লিখেছেন, যার মধ্যে পাতাবাহার অন্যতম।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৬৯ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।
১৯৭৩ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নেন। সাহিত্যচর্চার মধ্যেই পার করেন জীবনের শেষ আটটি বছর। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিপ্লবী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই পথিকৃতের “১১৮তম” জন্মদিনে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।