।। সাইফুর রহমান মিশু।।
একটি বক্তব্য কীভাবে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে, তেমন একটি উদাহরণ প্রমাণসহ দেখিয়ে দিয়েছি গতকাল একই পোস্টের ৮০টি ভিন্ন ভিন্ন আইডি ও পেইজের স্ক্রীনশটসহ। এটাকে বলে ম্যানুফেকচারড কনসেন্ট। এই মুহুর্তে বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকার এমন একটি কনসেন্ট দাঁড় করাতে চাইছে যে, তারা খুব সফল। রাজনীতিবিদ মানেই খারাপ। নির্বাচন তাই দরকার নেই। এজন্য তারা কিছু বায়বীয় সফলতার গল্প ফাঁদছে। যার পোস্টার বয় বর্তমানে আশিক চৌধুরী।
আশিক চৌধুরী নিজেই এই পরিকল্পনার অংশ। তাকে সহজ ভাববার কোন কারণ নেই। দেশে ফেরার সেই “৫৯ সেকেন্ডের” গল্প দিয়েই সেটা শুরু করেছে সে। সম্প্রতি বাংলাদেশে স্যামসাং-এর বিনিয়োগের বিষয়ে যা সে বলেছে তার পুরোটাই বানোয়াট ও মিথ্যা। ২০১৮ সালে ফেয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড -এর সাথে যৌথ উদ্যোগে স্যামসাং নরসিংদীতে মোবাইল ফোন এসেম্বলিং এর যাত্রা শুরু করে। ৫৮ হাজার বর্গফুটের এই কারখানায় প্রথম “মেইড ইন বাংলাদেশ” লেখা স্যামসাং এর মোবাইল সেট বিশ্ব বাজারে ছাড়ে।
স্যামসাং বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে ২০০৯ সালে। স্যামসাং আরএন্ডডি ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ, মোবাইল ফোনের এপ্লিকেশান ও বিটুবি সলুউশান বাংলাদেশেই তৈরি হয় ২০১৮ সালের মে মাস থেকে। তথ্যসূত্র
বিনিয়োগ সম্মেলনের আরেকটি প্রোপাগান্ডা ছিল স্টারলিংক নিয়ে। স্টারলিংক বাংলাদেশে পাইলট প্রকল্প শুরু করে এবং সফলভাবে তা পরীক্ষা করা হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে। তথ্যসূত্র বর্তমান সরকার এটা নিয়েও মিথ্যা প্রচারণা করেছে এবং সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন লিমিটেডে সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাদুর রহমানের নামে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছে। ইমাদুর রহমান সুইডেনের এরিক্সনে মুখ্য গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিল। “গবেষণা প্রধান” হিসেবে যেই প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেটা মিথ্যা। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ভাল। সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি আছে।
“কোটা না মেধা” স্লোগান দিয়ে কোন প্রতিযোগিতামূলক যাচাইয়ের ব্যবস্থা না করে সরাসরি এভাবে নিয়োগ অবশ্যই উক্ত স্লোগানের সাথে সাংঘর্ষিক। একই কথা প্রযোজ্য আশিক চৌধুরীর নিয়োগের ক্ষেত্রেও। ইমাদুর রহমানের নামে যে পেটেন্টের সংখ্যা উল্লেখ করা হচ্ছে উক্ত পোস্টে সেটিও মিথ্যা। জানামতে তার বেশ কিছু গবেষণাপত্র রয়েছে এবং এরিকসনের চাকুরীর সূত্রে দলীয়ভাবে সে ১০টি পেটেন্টের অংশীদার (আজকের তারিখ পর্যন্ত)। তথ্যসূত্র। যেগুলো ‘গ্রান্ট’ স্ট্যাটাস শুধু সেগুলো হিসেব করলে।
এবার আসি, বহুল প্রচারিত বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রাপ্তির হিসেবে। বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ছিল ৪০০ বিদেশিসহ ৫৫০ জন। তথ্যসূত্র। বিদেশিদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশী প্রবাসী। ডিল নিশ্চিত হয়েছে ২৬০ মিলিয়ন ডলারের, যার ১৬০ মিলিয়ন চীনা প্রতিষ্ঠান হাণ্ডার সাথে (হোন্ডা নয়) ও ১১০ মিলিয়ন পেয়েছে শপআপ। বাকি সবগুলোই কেবল প্রতিশ্রুতির পর্যায়ে আছে, যার মধ্যে আছে সুইডেনের নিলর্ন, যারা ১৩ মিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একাধিক স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণা দিয়েছে। চুক্তি সাক্ষর করেনি, কিন্তু। বিনিয়োগ করতে চেয়েছে ব্রিকস গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। মহাকাশ অনুসন্ধানে নাসার সঙ্গে চুক্তি (MoU) করেছে বাংলাদেশ, যা কার্যকর হবে আরও ২৫/৩০ বছর পরে। তবে তা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হয় কি না, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়েছিল ২০২২ সালে, যা ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। তথ্যসূত্র। ২০২৩ সালে ১৬% কম হয় তার আগের বছরের তুলনায়। এবার সেটা অর্ধ বিলিয়নও স্পর্শ করেনি।
বাস্তবতা হলো, বিনিয়োগকারীরা যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেয় কোন দেশে বিনিয়োগ করার জন্য সেগুলো হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিবেশ, কর ব্যবস্থা ও অবকাঠামো ইত্যাদি। এই যে একজন তথাকথিত “আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়” দেশের ক্ষমতা দখল করে বসে আছে যে কিনা বলেছিল, “আমরা কারো কাছে যাবো না, পুরো পৃথিবী আমাদের কাছে আসবে” – সে যে কতটা ব্যর্থ, তা কি প্রমাণিত নয়?
বিগত সরকারের কৃতিত্ব চুরি ও নাম পরিবর্তন ব্যতীত গত ৮ মাসে কোন প্যারামিটারেই অন্তত একটি সফলতাও দেখাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠিক কী পরিমাণ সরকারী অর্থ অপচয় করে গুণগানমূলক পোস্টে ছেয়ে যাচ্ছে। একটি দল সেসব খাচ্ছে ও গভীরে না ভেবেই হানিমুনে আছে নোবেলের সাথে। এমনটাও বলতে শুনেছি, মহাজন নাকি চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশের জন্য। অথচ, নিজের ও প্রতিষ্ঠানের কর মওকুফ, জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স, ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স, স্টারলিংকের সাথে গ্রামীণ টেলিকমের চুক্তি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ যাবতীয় সবকিছু করে নিয়েছে নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্যই ইতিমধ্যে।
এতো রেফারেন্স দিয়ে বিশ্লেষণ এড়িয়ে গিয়ে সেই হানিমুনে থাকা দল বলবে – “প্রেজেন্টেশন তো ভাল হয়েছে।” যে দেশের লাখ লাখ লোককে শুধু প্রেজেন্টেশন খাইয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে পারে “ডেস্টিনি” সেই দেশের মানুষতো এসবই খাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, ১৬ই জানুয়ারি ২০২৫ এর ডেইলি স্টারের সংবাদ মারফত জানা গেছে ডেস্টিনির সেই চেয়ারম্যানকেও মুক্তি দিয়েছে বর্তমানের অনির্বাচিত সরকার। তথ্যসূত্র।
লেখাটি ঘিলুবিহীন কোন জোম্বি গোষ্ঠীর জন্য নয়। সামান্যতম চিন্তাশক্তি অবশিষ্ট আছে যাদের মধ্যে তাদের জন্য।
পরিচিতি: ব্লগার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ