বিবিসির (BBC) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিভিন্ন জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত মামলায় অভিযুক্ত তিন শতাধিক ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কারাগার কর্তৃপক্ষের হিসেবে, এই সংখ্যা এখন ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সন্দেহভাজন, বিচারাধীন এবং এমনকি আগে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ব্যক্তিরাও।
বিবিসি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউ কেউ পূর্ববর্তী সরকারের আমলে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে ভুলভাবে আটক করা নিরপরাধ ব্যক্তি, আর কেউ কেউ আসলেই জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকা ব্যক্তি যারা এই পরিবর্তনের সময়টিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বিবিসিকে (BBC) জানান,
“তিন শতাধিক বন্দি মুক্তি পেয়েছেন, যাদের অনেকে বিভিন্ন জঙ্গি সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে সম্ভবত অভিযুক্ত ছিল। সরকার এ বিষয়ে সচেতন এবং যারা হিন্দুস্তানী ক্রাইম বা সরাসরি অপরাধকারিতায় জড়িত ছিল, তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ আবার পুনরায় গ্রেপ্তারও হয়েছে।”
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত এবং কারাবাস ভোগ করা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী বিবিসিকে (BBC) বলেন,
“বেশিরভাগ লোক নিরপরাধভাবে জেলে ছিল। আর যদি কিছু সামান্য ভুল করেও থাকে, তবে তারা ভুল বুঝতে পেরে তওবা করেছে।”
বিবিসির (BBC) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আট মাসে নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির সঙ্গে যুক্ত ১৪৮ জন জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া, হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া, আনসার আল ইসলাম, ইমাম মাহমুদের কাফেলা, হিজবুত তাহরীর, হামজা ব্রিগেড, কেএনএফ এবং আল্লার দলের মতো পূর্ববর্তী সরকারের তালিকাভুক্ত উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যরাও জামিন পেয়েছেন।
বিবিসি রিপোর্টে উল্লেখিত করা হয় যে, এই সংগঠনগুলোর জঙ্গি হিসেবে শ্রেণীবদ্ধকরণ বাংলাদেশে এখনও বিতর্কের বিষয়। মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী, যিনি ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, বিবিসিকে (BBC) বলেন, “আমার মনে হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে কোনো দলের অস্তিত্ব ছিল না। এটা তৈরি করা হয়েছিল বাংলাদেশকে একটা জঙ্গি রাষ্ট্র দেখিয়ে নিজেদের কিছু ফায়দা অর্জন করার জন্য।”
রাহমানী ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছিলেন এবং একাধিক মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। তিনি বিবিসিকে (BBC) আরো বলেন, “হাইকোর্টে জামিনের জন্য যখন গেলাম, তখন দেখা গেল আমি মামলার সাজার চেয়ে অনেক বেশি সময় জেলে কাটিয়েছি। এটি শেখ হাসিনার শাসনকালে হয়েছিল। নতুন জামিনটি বর্তমান সরকারের সময়ে দেওয়া হয়েছে।”
বিবিসির (BBC) প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, গত আট মাসে জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েকজন রয়েছেন, যা জঙ্গিবাদের শিকার ব্যাক্তিদের পরিবারের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। ২০০৬ সালে হত্যা করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ.এফ.এম. রেজাউল করীম সিদ্দিকীর পরিবার জানিয়েছে যে তাদের মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া দুই আসামি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। বিবিসি এটি নিশ্চিত করেছে।
রেজাউল করীমের ছেলে বিবিসিকে (BBC) বলেন,
“এর চেয়ে বড় হতাশা আর কিছু হতে পারে না। আমরা চাই নির্দোষ ব্যক্তি সাজা না পাক, কিন্তু যদি কেউ নির্দোষ দাবি করে, তবে তাকে প্রমাণ করতেই হবে। আমার মা বলেন, তিনি নিশ্চিত নন যে বেঁচে থাকতে ন্যায় দেখতে পাবেন কি না।”
পর্যবেক্ষকের মত
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, যিনি ১৯৮০-এর দশকের শেষ থেকে বাংলাদেশের উগ্রবাদী কার্যকলাপ নজর রাখেন, বিবিসিকে (BBC) বলেন, “বাংলাদেশের জঙ্গি নির্মূল অভিযানে সত্য এবং নাটকীয়তা দুটোই রয়েছে। সত্যিকারের জঙ্গি নির্মূলের প্রচেষ্টা ছিল, কিন্তু কখনো কখনো নাটকের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্দোষ মানুষকে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে আটক করেছে। কেউ কেউ নাটকীয় অভিযানে হত্যাও হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন,
“শুধু ভুলভাবে অভিযুক্তরাই জামিন পাচ্ছেন না; আসল জঙ্গিরাও জামিন পেয়েছে বা জেল থেকে পলায়ন করেছে। মূল অপরাধীরা এই সময়টিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।”
সুরক্ষা উদ্বেগ
বিবিসির (BBC) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে অতীতে বড় জঙ্গি হামলা, দেশজুড়ে বোমা বিস্ফোরণ এবং ব্লগার, শিক্ষক, প্রকাশক ও বিদেশি নাগরিকদের হত্যা ঘটেছে। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান হামলা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ২০০৩-২০০৬ সালে জঙ্গি তৎপরতা জাতীয় স্তরে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।
নূর খান লিটন বিবিসিকে (BBC) বলেন, “সব জঙ্গি মামলা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রকৃত মামলা বিচার হওয়া উচিত, আর মিথ্যা অভিযোগ বাতিল করা দরকার।”
কারাগারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাইয়ের উত্থানে ৫টি জেল থেকে ২ হাজার ২০০ বন্দি পলায়ন করেছিল, যার মধ্যে ৭০০ জন এখনও ধরা পড়েনি। পলাতকদের মধ্যে ৬ জন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিল। ৫ আগস্টের পর ৩৪৬ জন, যার মধ্যে ১২ শীর্ষ জঙ্গি, ৮ জন দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি এবং অন্তত ১০টি নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য, জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
লিটন সতর্কতা জানান, “অনেক অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি। যদি এগুলো ভবিষ্যতে জঙ্গি কাজে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হবে।”
সরকারের অবস্থান
মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী বিবিসিকে (BBC) দাবি করেন, “জামিনে মুক্তির ফলে কোনো সুরক্ষা ঝুঁকি নেই। যারা মুক্ত হয়েছে, তারা কোনো অপরাধ করেনি। বেশিরভাগ নিরপরাধ, আর যারা ভুল করেছিল, তারা তওবা করেছে। তারা বুঝেছে এ পথ ভুল।”
তবে, বিবিসির (BBC) প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয় যে, কিছু পর্যবেক্ষক বলছেন, উগ্রবাদী তৎপরতা আবার বাড়ছে। নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীর ‘মার্চ ফর খিলাফত’ আয়োজন করেছে, এবং মাজার ভাঙা, মব আক্রমণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা বাড়ছে।
সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বিবিসিকে (BBC) বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মাজার ভাঙা, সংখ্যালঘু আক্রমণ বা ব্যবসা হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মুক্ত ব্যক্তিদের নজরদারি করা হচ্ছে। যদি তারা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করে, তবে তৎক্ষণাৎ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
তিনি আরো বলেন, গত আট মাসে তিন শতাধিক জামিনে মুক্তির মধ্যে কেউ কেউ পুনরায় গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিস্তৃত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে, এবং পুলিশ প্রধান বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।