দেশজুড়ে সহিংসতার মাধ্যমে গত বছরের মধ্যভাগ থেকে দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিল্পখাতে বিশৃঙ্খলা, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে স্থবিরতা এবং সার্বিক অস্থিরতার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৯ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এর আগের পূর্বাভাসের তুলনায় এবার প্রবৃদ্ধির হার আরও উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
এডিবি জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করবে। মূল্যস্ফীতির হার পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। বুধবার প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত সেপ্টেম্বর সংস্করণে এডিবি চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৫.১ শতাংশ হবে বলে জানালেও, এখন তা সংশোধন করে ৩.৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এরও আগে, গত বছরের এপ্রিল সংস্করণে এডিবি প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ হবে বলে আশা করেছিল। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক গতি কমে যাওয়ায় সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়নি। এডিবির মতে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে প্রবৃদ্ধি ৫.১ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.২ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির দিক থেকেও আশাব্যঞ্জক কিছু নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনও ঊর্ধ্বমুখী এবং বছরের শেষে আরও বাড়বে বলেই পূর্বাভাস।
এ বছরের এপ্রিল মাসে এডিবি বলেছিল, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা সংশোধন করে ১০ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আভাস দেয়। সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শেষে তা ১০.২ শতাংশে পৌঁছাবে। তবে আগামী অর্থবছরে কিছুটা কমে ৮ শতাংশে নামার সম্ভাবনা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে এডিবি— যেমন পাইকারি বাজারে প্রতিযোগিতার ঘাটতি, তথ্যের অভাব, সরবরাহ চেইনের সীমাবদ্ধতা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি আরও বলছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে রপ্তানিতে প্রভাব পড়েছে, আবার জ্বালানি সংকটও অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলেছে। চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যে ব্যয় ও বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও রপ্তানি খাত প্রবৃদ্ধির গতিকে আটকে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু কোটা আন্দোলনের নামে সরকার পতনের সহিসংতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মাধ্যমে শেখ হাসিনার শাসনকালের অবসান হয়। এর ফলে সবকিছুতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যায়।
গত ৫ই আগস্টের আগে এক মাসের বেশি সময় ধরে শিল্প ও ব্যবসায় কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছিল উদ্দেশ্যপ্রণ্রোদিতভাবে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হলেও ব্যবসা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লেগেছে। যদিও পোশাক খাতে অস্থিরতা থাকলেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বজায় রয়েছে।
এডিবি বলছে, “রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিল্প খাতে অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমছে।”
এডিবির বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জেয়ং এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মাঝেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে এই স্থিতিশীলতা আরও জোরদার করা সম্ভব।”
তিনি বলেন, “শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভর না করে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে হবে। এজন্য দরকার বেসরকারি খাতের বিকাশ, টেকসই অবকাঠামো, জ্বালানি নিরাপত্তা, আর্থিক খাতের সুশাসন ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ। এসব উদ্যোগ প্রবৃদ্ধি বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াবে।”
এডিবি আরও বলেছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ কিছুটা গতি পাবে, তবে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কড়াকড়ি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা সেই গতি সীমিত করে রাখবে। বিশ্ববাজারে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবও বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।
সরবরাহ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং গৃহস্থালী ব্যয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কয়েক দফা বন্যার কারণে কৃষি খাতেও প্রবৃদ্ধি কমবে, তবে রপ্তানিমুখী শিল্প উৎপাদন বাড়ায় শিল্প খাতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
এডিবির এই পূর্বাভাসের সময় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যে ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ হলে মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৫২ শতাংশ, যেখানে আগে ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, এতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও চাপে পড়বে এবং প্রবৃদ্ধির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। নতুন শুল্কারোপের পর এডিবি যদি তথ্য সংশোধন করে, তবে পূর্বাভাসে আরও ভয়ানক চিত্র উঠে আসবে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদরা।