।। শামীম আহমেদ।।
ভারত ৮ এপ্রিল ২০২৫ বাংলাদেশের সাথে তাদের ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তি শুরু হয় ২৯ জুন ২০২০ সালে। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশী পণ্য ভারতের স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে অন্য দেশে পরিবহণ করা সহজ ছিল। এটি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের আকাশপথ ছাড়া আর কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। তাই ভারতের মধ্য দিয়ে সুলভে বাংলাদেশ, ভুটাল ও নেপাল নিজেদের মধ্যে পণ্য আমদানি, রপ্তানী করতে পারত। দুই, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং আমাদের ছোট দেশের অল্প কিছু এয়ারপোর্ট ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানীকারকরা সবসময় সব পণ্য পাঠিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। নানা সময়ে দ্রুত পণ্য রপ্তানীর জন্য ভারতের নানা স্থল বন্দর ও এয়ারপোর্ট ব্যবহার করা তাদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। বিশেষত দিল্লি এয়ারপোর্টের উপর তাদের একটা বড় নির্ভরযোগ্যতা তৈরী হয়েছিল গত ৫ বছরে।
এখন আলোচনার বিষয় ভারত হঠাৎ এই ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি কেন বাতিল করল! আমি প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, প্রথম আলো, জনকন্ঠসহ বাংলাদেশের নানা ভ্লগারের এই বিষয়ের নানা বিশ্লেষণ ও খবর পড়লাম গত ২ দিন ধরে। এছাড়া ভারতীয় নানা ইউটিউব চ্যানেলের সংবাদ ও ভারতীয় পত্রিকার মধ্যে The Economic Times, Indian Express, India Today, আনন্দবাজার পড়লাম। সব পড়ে কেন ভারত এই সুবিধা বাতিল করেছে তার সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করছি।
১) আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পররাষ্ট্র দফতর ও অন্যান্য সরকারী সংস্থা যেটি বলছে সেটি হলো, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের আভ্যন্তরীণ রপ্তানীকারকরা বিশেষত ভারতের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা ভারত সরকারকে বলে আসছিল যে বাংলাদেশী গার্মেন্টসের পণ্যবাহী ট্রাক তাদের দেশে স্থল ও বিমানবন্দরে অহেতুক ভিড় লাগিয়ে রাখছিল, ফলশ্রুতিতে তাদের নিজেদের পণ্য পরিবহনে সমস্যা হচ্ছিল। তারা উল্লেখ করেছে প্রতিদিন কেবল দিল্লি এয়ারপোর্টেই বাংলাদেশের পণ্যবাহী ২০-৩০টি পণ্যবাহী ট্রাক যেত। তারা বলছিল প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশকে এইসব বন্দর ও এয়ারপোর্ট ব্যবহার করতে না দিলে ভারতের পণ্যের রপ্তানী সহজ হবে।
২) তারা এও বলেছে বাংলাদেশের পণ্য ভারতের ভেতর দিয়ে যাবার কারণে যেহেতু পণ্যবাহী বিমানের অনেক চাহিদা তৈরী হয়েছিল, তাই তারা পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকখানি। বাংলাদেশকে দেয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে সেই চাহিদা কমার ফলশ্রুতিতে তারা ভাড়া কমিয়ে দেবে ফলে, ভারতীয় গার্মেন্টস পণ্য সহজে ও সুলভে পশ্চিমা বিশ্বে পৌঁছে যেতে পারবে।
ভারতীয় নানা সরকারী মুখপাত্ররা তাদের আনুষ্ঠানিক এবং দাপ্তরিক পরিভাষায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবীকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের ব্যবসার পরিবেশ সমুন্নত রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে গত ৫ বছর ধরে কেন নিজেদের ক্ষতি করে তারা এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছিল বাংলাদেশকে?
এই বিষয়ে আমার বিশ্লেষণ বলে,
১) বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়ায় ভারতের যে কিছুটা ক্ষতি হচ্ছিল এটি সত্য। তবুও তারা এই সুবিধা বাংলাদেশকে দিয়েছিল কারণ ভারত বাংলাদেশের পূর্ববর্তী অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারকে বন্ধুপ্রতীম ভাবত এবং যেহেতু বাংলাদেশের বিগত সরকারও ভারতকে নানা সুবিধা দিয়েছে, তাই এই ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি ছিল পারস্পরিক আস্থা, ভরসা ও আদান-প্রদানের সম্পর্কের জায়গা থেকে প্রণীত।
২) বাংলাদেশের বর্তমান অনির্বাচিত সরকারকে ভারত আর তাদের বন্ধু ভাবছে না। বাংলাদেশে ৫ অগাস্টের পর থেকে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতন, ইসলামী মৌলবাদের উত্থান, দ্রুত সন্ত্রাসবাদ ও বিচারহীনতার প্রসার এবং সেটি রোহিত হবার কোন লক্ষণ না দেখা যাওয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে অযাচিত আর কোন সুবিধা দিতে চাচ্ছে না। ভারতের অভ্যন্তরে তাদের নাগরিকরাও এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তাই চুক্তি বাতিলের পক্ষে একটি জোরালো কারণ তৈরী হয়েছিল।
৩) ভারতের সরকারী বক্তব্যে যা উঠে আসেনি সেই কারণটি ভারতের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। মূলত গত ২৬ থেকে ২৯ মার্চ চায়না সফরের সময় তার বক্তব্যে ইউনুস সাহেব কিছু কথা বলেছেন যেটি ভারতের পছন্দ হয়নি। আমি একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বলব, ইউনুস সাহেবের বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার লঙ্ঘন করেছে এবং অত্যন্ত আগ্রাসী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে যা চায়ের দোকানে আড্ডার জন্য ঠিক থাকলেও একটি বন্ধু রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের শত্রু রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য আপত্তিকর ও অনভিপ্রেত বিবেচিত হতে পারে। যেটির প্রতিক্রিয়ায় ভারত বাংলাদেশের বিগত সরকারকে দেয়া সুবিধাটা বাতিল করল।
ইউনুস আসলে সেখানে কী বলেছিলেন? ইউনুস চায়নাকে উদ্দেশ্য করে ভারতের কিছু অংশ নিয়ে বলেন, “The seven states of eastern India, known as the Seven Sisters, are a landlocked region. They have no direct access to the ocean. We are the only guardian of the ocean for this entire region. This opens up a huge opportunity. It could become an extension of the Chinese economy — build things, produce things, market things, bring goods to China and export them to the rest of the world.”
যা বাংলা করলে দাড়ায়, “ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য, যেগুলোকে ‘সেভেন সিস্টারস’ বলা হয়, সেগুলো স্থলবেষ্টিত এলাকা। তাদের সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এই পুরো অঞ্চলের জন্য আমরাই একমাত্র সমুদ্রপথের অভিভাবক। এটি এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। এটি চীনা অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণে পরিণত হতে পারে — জিনিস তৈরি করা, উৎপাদন করা, বাজারজাত করা, চীনে পণ্য নিয়ে যাওয়া এবং সেগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রপ্তানি করার জন্য।”
ইউনুস সাহেবের এই বক্তব্য অত্যন্ত অযাচিত ও আপত্তিকর। ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সেখানকার সাতটি অঙ্গরাজ্য কীভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করবে সেটি তিনি একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আগে বলতে পারতেন, কিন্তু বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে তিনি তাদের অনুমোদন ছাড়া বলতে পারেন না। বিশেষত চায়না ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এমনকি শত্রুও বলা চলা। ভারতের সেভেন সিস্টার্স যেহেতু মূল ভূখন্ড থেকে বেশ বাইরে এবং কেবলমাত্র একটি ২১ কিলোমিটারের সংযোগস্থল দিয়ে ভারতের সাথে সংযুক্ত তাই এই অঞ্চলে চায়না নানাভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরী করার চেষ্টা করে নিয়মিত। এখন এই অঞ্চলটিতে বাংলাদেশের সমুদ্রের অভিভাবকত্বের সুবিধা নিয়ে চায়না ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারে – এটি অত্যন্ত উস্কানিমূলক বক্তব্য যেখানে ইউনুস বিষয়টি এমনভাবে আলোচনা করেছেন যে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে সকল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও চায়না-ই নিবে, এখানে ভারতের কিছু বলার নেই! মূলত তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রথমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে পরবর্তীতে বিমসটেক সম্মেলনের এক দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় “অযাচিত কথা না বলার পরামর্শ দেন” – যা বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক ছিল। ইউনুস সাহেব তার অদক্ষ মন্তব্যের মাধ্যমে দেশের জন্য এই অপমান বয়ে আনেন।
ভারতের এপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল মিথিলেশ্বর ঠাকুর যদিও এই চুক্তি বাতিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কারণ বলে উল্লেখ করেছেন, ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়াটিভের প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, “তবে, চীনের সহায়তায় বাংলাদেশের চিকেনস নেক এলাকায় একটি কৌশলগত ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনাই হয়তো এই ভারত সরকারের এই পদক্ষেপের পেছনের মূল কারণ হতে পারে। ভারতীয় শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি লালমনিরহাটে বিমানঘাঁটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বাংলাদেশ চীনা বিনিয়োগ আহ্বান করেছে।”
ইউনুসের মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সেভেন সিস্টার্সের একটি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন ভারতের উচিৎ তাদের দুই প্রান্তের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা যাতে অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হয়।
এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি একজন কূটনীতিকের মতোই বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়েছেন যেখানে কোন উস্কানি কিংবা অযাচিত নাক গলানো মন্তব্য নেই এবং যেটি থেকে ইউনুস শিক্ষা নিতে পারেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর বলেন যে ভারত পারস্পরিক সহযোগিতাকে একটি সমন্বিত উদ্যোগ হিসেবে দেখে, কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে নয়। তিনি আরও বলেন, “আদতে আমাদেরই বঙ্গোপসাগরে প্রায় ৬,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘতম উপকূলরেখা রয়েছে। ভারত শুধু পাঁচটি বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গেই সীমান্ত ভাগ করে না, তাদের অধিকাংশের সঙ্গে সংযুক্তও রয়েছে, এবং ভারতই ভারতীয় উপমহাদেশ ও আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে প্রধান সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ধীরে ধীরে বিমসটেক অঞ্চলের জন্য একটি সংযোগকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে, যেখানে রাস্তাঘাট, রেলপথ, জলপথ, বিদ্যুৎ গ্রিড ও পাইপলাইনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে।”
ভারত আরও জানায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে স্থলপথে যোগাযোগে ভারত কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না। তবে এই চুক্তি বাতিলের মাধ্যমে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প দ্রুততম সময়ে বিকল্প পথে পণ্য পরিবহণের একটি অনন্য সুযোগ হারালো যেটি তাদের পণ্যের দাম বাড়াবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পণ্যের দাম কমাবে সাথে সাথে তাদের পরিবহণের সময় কমাবে।
আলোচনাটির সমাপ্তি টানলে বলা যায় ভারত-বাংলাদেশের ক্রমাগত সম্পর্কের অবনতির ধারাবাহিকতায় এই ঘটনাটি ঘটল। বিশেষত ইউনুস যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন তা যে অপরিকল্পিত তা মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হলেও ইউনুস একজন বুদ্ধিমান মানুষ। সুতরাং তিনি যা বলছেন তা উদ্দেশ্যমূলক কিন্তু তার শঠতার কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ভুগতে পারে বলে মনে হচ্ছে। সাথে সাথে এটিও বলা যায় ভারত সরকার তার আভ্যন্তরীণ চাপ সামলেও যে সুবিধা বাংলাদেশকে দিচ্ছিল সেটি শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য ছিল। এখন তার পতনে বাংলাদেশ সে সুযোগ হারাল।
তথ্য-উপাত্ত ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিলের যতটুকু জানানো দরকার আপনাদের জানালাম। স্বভাবতই বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে যারা সত্য জানতে চান তারা এই লেখাটি পছন্দ করবেন। আর অন্ধ উগ্রবাদে বিশ্বাসীরা পুরো লেখাটিও পড়বার যোগ্যতা রাখেন না, তাই তাদের অবস্থান কী হবে সেটি সহজেই অনুমেয়।
লেখক, গবেষক, ওন্টারিও, কানাডা।