।।কবির য়াহমদ ।।
‘আওয়ামী লীগকে মিছিল করতে দেওয়া হবে না’, এভাবে যদি বলেন, তবে এতে ভয় পাবেই না আওয়ামী লীগ, বরং দলটিকে আরও বেশি তাঁতিয়ে দেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে তখন মিছিল করতে থাকবে আওয়ামী লীগ। সারাদেশের প্রতিটি পয়েন্টে, রাজধানীর সবকটি জায়গায় আপনি পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-সেনাবাহিনী দিয়ে রাখতে পারবেন না। মিছিল করার জন্যে কোনো না কোনো জায়গা থাকবেই। তেঁতে ওঠা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মাঠে নামবেই।
এছাড়া ‘মিছিল করতে দেওয়া হবে না’ বললে আপনি এমন একটা দলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধঘোষণা করে বসলেন, যাদের জন্মই হয়েছে মিছিল দিয়ে, আন্দোলন দিয়ে। এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আপনি পার পাবেন না। আওয়ামী লীগ আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠবে মিছিলে। আগে যেখানে মিছিলে হতো হাতেগোনা কিছু লোক, তখন দেখবেন দিন দিন মিছিলে লোকসংখ্যা বাড়ছে। হচ্ছেও এমন।
মিছিল করতে না দেওয়ার নৈতিক কোন ভিত্তি নেই, আইনি কোন ভিত্তি নেই, রাজনৈতিক অধিকার প্রশ্নে আপনার কোন ভিত্তি নেই; এটা স্রেফ ক্ষমতা প্রদর্শন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আর এমন একটা দলের বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন, যারা নেতৃত্ব সংকটে আছে ঠিক, কিন্তু সমর্থন ও আস্থা সংকটে নেই। তার ওপর গত আট মাসের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এই দলের অনেক সমর্থককে একই কাতারে নিয়ে এসেছে, যারা এতদিন অভিমানে দূরে ছিলেন, বঞ্চনায় দূরে ছিলেন, অনুপ্রবেশকারীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলেন, তারাও এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছেন।
নেতৃত্ব সংকটে থাকা আওয়ামী লীগ বর্তমানে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ যে, ইতিহাসে এমন ঐক্য আগে দেখা যায়নি। খেয়াল করে দেখুন, দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা কেন ভারত গেলেন–শুরুর এই প্রশ্ন এখন আর নাই। বরং দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীর বিশ্বাস জন্মেছে, শেখ হাসিনা সেদিন গণভবন ত্যাগ না করলে তাঁকে মেরেই ফেলত উশৃঙ্খল মব। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু শেখ হাসিনাকে হারাতে রাজি নয়। ঠিক এই এক জায়গাতেই দেশের সকল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ভাবনাচিন্তা এক ও অভিন্ন।
আওয়ামী লীগকে মিছিল করতে দেওয়া যাবে না, রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না, ভোটে অংশ নিতে দেওয়া যাবে না, নিষিদ্ধ করতে হবে; এ-আওয়াজগুলো রাজনৈতিক নয়। এটা ফ্যা-সি-বাদী চিন্তা। ফ্যা-সি-বাদী দর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দুরভিসন্ধি। এমন চিন্তা, এমন দাবি, এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়নি আগে দেশে। আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল; কিন্তু এমন ফ্যা-সি-বাদী চিন্তার প্রকাশ এত প্রকাশ্য ছিল না। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার প্রকাশ ছিল না।
জুলাই-আগস্টের অস্থিরতায় দেশে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। আন্দোলন দমনে বলপ্রয়োগ হয়েছে, পাল্টাপাল্টিতে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সকল মৃত্যুই অপ্রত্যাশিত। এগুলোর বিচারের দাবি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত। এই দাবিতে ব্যক্তিগতভাবে আমিও একাত্ম। সরকারি হিসাবে এই মৃতের সংখ্যা ৮ শতাধিক, জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান দলের হিসাবে এই সংখ্যা ১৪০০। সরকারি হিসাবের বাইরের যে হিসাব সেটা ৫ই আগস্টের পরের। সরকার আগে মৃত্যুগুলোর বিচার করছে, করবে; বাকি মৃত্যুগুলোর বিচার তারা করবে না। না করতে তারা দায়মুক্তি দিয়েছে সরকারি ফরমানে। এই যে ছয়শ লোকের মৃত্যু, এটা কি হিসাবের বাইরে থাকবে, থাকা কি উচিত? শ-শ পুলিশ যে মারা হলো, সেটা কি বিচারের বাইরে থাকবে? থাকা কি উচিত? আমার তো মনে হয় না।
আমার কাছে সকল মৃত্যুই সমান। এখানে আবু সাঈদ যেমন, রাম-রহিম-যদু-মধুও তেমন! আপনি আলাদা চোখে দেখলে তো হবে না। এখানে বিশেষ কাউকে নিয়ে আদিখ্যেতা দৃষ্টিকটু, তেমনি কাউকে অগ্রাহ্য করাও অমানবিক।
মৃতদের নিয়ে বিভাজন আমরা দেখছি শুরু থেকেই। আবু সাঈদ নামের একজনকে যেভাবে হাইলাইট করা হয়, সেখানে গ্রাহ্য করাদের মধ্যেও ওয়াসিম আকরাম নামের ছাত্রদলের একটা নেতাকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুলিশসহ আরও অনেককে তো বাদ দেওয়া হয় একপ্রকার প্রকাশ্যে। এগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার।
গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। দল ও সরকার পৃথক প্রপঞ্চ। একটা দলের সবাই সরকারে থাকে না। একটা সরকার প্রতিনিধিত্বশীল নির্দিষ্ট কিছু লোকের সমাবেশ, এর বেশি কিছু নয়। অন্যদিকে দল মানে কোটি কোটি লোকের সমর্থন, আবেগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্ধত্ব। এই আবেগের মধ্যে থাকা লোকদের এক শতাংশও হয়ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে সারাজীবনে একবারও সরাসরি দেখেনি, তবু তারা সমর্থনের প্রশ্নে অনড় অবস্থানে। তাদের মধ্যে এমনও অনেক লোক আছে দেখবেন, যারা নিজেরা নিজেদের দলের সমালোচনা করলেও, আপনি যদি সমালোচনা করতে আসেন, তবে ঠিকই প্রতিবাদী হয়ে ওঠবে।
বিষয়টা কেবল শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, একই কথা প্রযোজ্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। এটাকে আপনি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। এই অবস্থা আপনি বদলাতে পারবেন না।
আপনি-আমি স্বীকার-অস্বীকার যাই করি না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাতেই। নৌকা আর ধানের শীষ; এ-দুটো প্রতীকেই মানুষের আস্থা। এখানে অন্তর্বর্তী সময়ে নতুন কেউ আসতে পারে, ভাসমান ভাবনাচিন্তার মানুষেরা কিছুদিনের জন্যে ওসবে মাঝেমাঝে আস্থা খুঁজলেও দিনশেষে তারাও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখপানে চেয়ে। এটা বদলাবে না। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা চলমান। আমরা এখানে এর একটা একক কেবল।
এই যে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ নামে একদল লোকের আবির্ভাব ঘটেছে দেশে; এতদিন এরা কোথায় ছিল? গত বছরের জুলাই-আগস্টের আগে এদের নামও তো শুনেনি দেশের কেউ। তারা যোগ্যতার প্রশ্নে উত্তীর্ণ নয়। উদ্দেশ্য সম্পর্কেও প্রশ্নবিদ্ধ। উড়ে এসে জুড়ে বসা তারা। তারা ক্ষণিকের অতিথি। এসেছে হঠাৎ, চলেও যাবে সে ভাবে। তাদের নিয়ে মাতামাতি তাই ক্ষণিক। আট মাসের দেশ পরিস্থিতি কি সে কথা বলছে না? শুরুতে তাদের নিয়ে মানুষের কী ভাবনা ছিল, আর এখন কেমন; ঠিক এটা ভাবলেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়!
জনপরিসরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এমনই যে, চাইলেও তাদের আটকে রাখতে পারবেন না। আপনি যত আক্রোশে তাদের দমনে নামবেন, তারচেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে তারা সংগঠিত হবে, এর প্রকাশ ঘটাবেই। আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন আন্দোলনের সময়ে বিএনপিও কয়েক মিনিটের ঝটিকা মিছিল করত। ওই সব মিছিলের লোক সমাগম নিয়ে যত ঠাট্টা করা হোক না কেন, কয়েক মাসের ব্যবধানে তারা দেশে এখন শক্ত অবস্থানে। এখন যে ভাষায় আওয়ামী লীগকে দমনের কথা বলছে সবাই, অনুরূপ ভাষা আগে ছিল না। আগে বিএনপি ঝটিকা মিছিল দিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করত। আর এখন আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল নিয়ে অস্তিত্বের জানান দিতে উজানে নাও বাইছে। অস্তিত্বের জানান দেওয়া যে মিছিলের শরীরীভাষা, তার প্রভাব কিন্তু বিশাল!