অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী অধিকার রক্ষায় বিশদ সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
মোট ৪৩৩টি সুপারিশের মধ্যে কর্মজীবী নারীদের জন্য এসব সুপারিশ ছিল। সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে তিন ধাপে— অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয়, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং দীর্ঘ নারী আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ভিত্তিতে।
‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয়’ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন মৃত সন্তান প্রসব, সন্তানের মৃত্যু বা দ্বিতীয় বিয়েতে সন্তানের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত শিথিল করা এবং দত্তক সন্তানের জন্যও ছুটির বিধান রাখতে হবে। পিতৃত্বকালীন ছুটির জন্য পূর্ণকালীন বেতনসহ দুই সপ্তাহের ছুটি ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। নারীপক্ষ–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে প্রধান করে গঠিত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
প্রসূতিকালীন ছুটি চারবার পর্যন্ত শিথিল করার সুপারিশ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম গণমাধ্যমকে বলেন, যেসব কারণ উল্লেখ করে চারবার পর্যন্ত ছুটি শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, তা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ও দুই সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্যই বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি শনিবার সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ওই কমিশনের কিছু সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বলে শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার— এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে।
গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো হল–
• অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
• অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
• পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন সংশোধন করা এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০–৫০ ভাগ নিশ্চিত করা।
• সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচন।
• বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা।
• যে কোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা।
• শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা।জামায়ত, খেলাফত মজলিস ও হেফাজত এই সুপারিশনামা প্রত্যাখ্যান করে বাতিল করার দাবী জানিয়েছে। তারা ইসলামের সাথে সুপারিশগুলো সাংঘর্ষিক মনে করছেন।