আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের বিক্ষোভ মিছিল বের করার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশত মিছিল হয়েছে। সারা দেশে জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীরা মিছিল বের করছে। এসব মিছিল অংশগ্রহণকারী প্রতিবাদী কর্মীদের প্রত্যয় অত্যন্ত স্পষ্ট। নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়, নিয়মিত পোস্ট দিচ্ছেন। মিছিলের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশে, তাতে উদ্দীপ্ত হচ্ছেন আত্মগোপনে থাকা কর্মীরাও। একে একে বেরিয়ে আসছেন প্রকাশ্যে।
এদিকে, মিছিলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বেড়েছে। গত ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ১লা মার্চ পর্যন্ত ২২ দিনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের দমনের জন্য পরিচালিত ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযানে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সাড়ে ১২ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে একটু রক্ষণাত্মক ভূমিকা নেয়।
রোববার বাড্ডায় আওয়ামী লীগ একটি মিছিল করে। মিছিল উত্তর বাড্ডা থেকে রামপুরা বাজারে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে ৩ শতাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। আধাঘণ্টার এই মিছিলের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বাদানকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ দল নয়। তবুও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হুমকি দিয়েই বলেছেন, আওয়ামী লীগের মিছিল কন্ট্রোল করতে না পারলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের মিছিল নিয়ে পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে মিছিল না হতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা কন্ট্রোল না করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সহস্রাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশব্যাপী ১,৬০১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১,০৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা বা ওয়ারেন্ট ছিল, বাকিদের অন্যান্য অভিযোগে ধরা হয়েছে। অভিযানে দেশীয় অস্ত্র ও একটি রাবার বুলেটও উদ্ধার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার আগেই সারা দেশে পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান নামে। গত ১৬ই এপ্রিল দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধা-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ সারওয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ৬ই এপ্রিল রাজধানীর মহাখালী থেকে রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত ১৭ই এপ্রিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদকে ডিবি গ্রেপ্তার করে।
পরদিন ১৮ই এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী যুবলীগের ৫০নং ওয়ার্ডের সভাপতি মো. আরিফ হোসেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৩নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. শাখাওয়াত, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সহ-সভাপতি বাপ্পি রায়হান, ঢাকা মহানগরীর ২০নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি মো. শাহাবুদ্দিন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ভাতিজা এবং মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
শনিবার রাজধানীতে যাত্রাবাড়ী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন হোসেন ফাহিমসহ ছাত্রলীগের ৬ নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অপর গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- ৫৯নং ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সহসভাপতি শেখ মো. সোহেল, বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক মো. সোহেল রানা, বাড্ডা থানার ৩৭নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়ামিন, ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল বাশার খান ও পল্লবী থানা ছাত্রলীগের ৫নং ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নাইম। এর পাশাপাশি ঢাকার বাইরে সারা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের অর্ধশত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, ডেমরা, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, লালবাগসহ অর্ধশত জায়গায় মিছিল করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ছাত্রলীগসহ সমমনা সংগঠনের মিছিল ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মিছিলের সময় তাৎক্ষণিকভাবে সবাইকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলেও পরবর্তীতে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অনেককে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, জনবিচ্ছিন্ন ও বেআইনি সংগঠনের অপতৎপরতা দমনে তারা তৎপর রয়েছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মো. তালেবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ছাত্রলীগ মিছিল করলেই গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, “ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী কেউ মিছিল বা সমাবেশ করতে চাইলে পূর্বানুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া সড়কে মিছিল করলে এবং জনদুর্ভোগ বা যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় দলীয় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ১৮ দিনে গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ-সংগঠনের ৩ শতাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে গত ১৩ই এপ্রিল ৩১ জন, ১২ই এপ্রিল ৪৫ জন, ১১ই এপ্রিল ২৮ জন, ৮ই এপ্রিল ২৯ জন, ৭ই এপ্রিল ৩৯ জন, ৬ই এপ্রিল ৪৪ জন, ৩রা এপ্রিল ৩৯ জন, ২রা এপ্রিল ২৯ জন ও ১লা এপ্রিল ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা রহিম উদ্দীন খান ও তার ছেলে রবিন খানকে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজশাহীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাহাবুল ইসলাম কমল এবং মহানগর তাঁতী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকশেদউল আলম সুমন।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল এবং নাভারণ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান আলীকে রোববার গ্রেপ্তার করা হয়। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় যুবলীগ নেতা মাসুক মিয়াকে শনিবার ভোরে ভবানীগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঝিনাইদহ জেলায় গত ১৫ দিনে অন্তত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও খুলনায়ও আওয়ামী লীগের মিছিলে অংশগ্রহণের অভিযোগে শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশের এমন কঠোর অবস্থান এবং ধারাবাহিক গ্রেপ্তার অভিযান সত্ত্বেও দলীয় মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ। যা একদিকে যেমন তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে, অন্যদিকে বিপুল বিক্রমে রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পূর্বাভাসও দিচ্ছে।