রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় আট কিলোমিটার দুরে ‘বালাইর খাল’ । ১২ এপ্রিল ১৯৭১ মধ্যরাত। পাকিস্তান আর্মির তিনটি লরী এসে থামলো। সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ আর অশ্লীল গালিগালাজে আতংকিত স্থানীয় মানুষেরা নিস্প্রদীপ অবস্থায় ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলেন, লরীগুলো থেকে নামানো হলো শ’দেড়েক মানুষকে। সবার চোখ আর হাত বাঁধা। একটানা গুলী বর্ষনে হত্যা করা হলো সবাইকে। পরদিন ভয়ে ভয়ে বধ্যভূমির কাছে গেলেন স্থানীয়রা। কিছু লাশ দেখে তাঁদের মনে হলো- বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিংবা ইপিআরের বাঙালী সৈন্য। একজন পরিচিত মুখ। ডাক্তার জিকরুল হক। ‘৭০ এর নির্বাচনে নীলফামারী মহকুমার সৈয়দপুর থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও থানা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক। বাকীদের পরিচয়ও জানা গেলো পরে। সবাই সৈয়দপুরের বিশিষ্ট বাঙালী ব্যক্তিত্ব। কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ রাজনীতিবিদ- এঁরা সবাই মার্চের শুরুতে গঠিত ‘সংগ্রাম পরিষদ’-এর নেতা। এঁদের নেতৃত্বেই এখানে গড়ে উঠেছিলো স্বাধিকার আন্দোলন।
থানা শহর হলেও সৈয়দপুরে ছিল দেশের সর্ববৃহৎ রেল কারখানা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত একটি বিমানবন্দর, সেনানিবাস, নীলফামারী মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তার অফিস ও বাসভবন। আকাশ, সড়ক, রেলপথে সারাদেশে যোগাযোগের সুবিধাসহ কৌশলগত নানা কারণে পাকিস্তান সরকার উত্তরবঙ্গে তাদের প্রতিরক্ষার অন্যতম জোন হিসেবে নির্বাচন করে সৈয়দপুরকে। সে পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত বিপুল সংখ্যক উর্দুভাষীকে এখানে রেলওয়ের চাকরী সহ নানা সুবিধা দিয়ে অভিবাসন করানো হয়। আশেপাশের গ্রামগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও সৈয়দপুর শহরে বাঙালীরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়। এ ছাড়া দেশভাগের আগে থেকে এখানে কয়েকশো পরিবার মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরাও ছিলেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে পাকিস্তানি শাসকদের মতো মনোক্ষুণ্ন হয় সৈয়দপুরের বিহারিরাও। এসময় তাদের উত্থাপিত বিভিন্ন দাবী দাওয়ায় প্রেক্ষিতে বাঙালীদের সাথে সম্পর্কের চুড়ান্ত অবনতি ঘটে। দাবীগুলোর মধ্যে ছিল- বাঙালিদের উর্দুতে কথা বলার আহ্বান, সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুল ও সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে উর্দু মিডিয়াম চালু, প্রেক্ষাগৃহে বাংলা সিনেমা প্রদর্শনে বাধাদান ইত্যাদি। তাছাড়া বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে অবাঙালি তরুণরা কালি লেপন করে শহরের বিভিন্ন মোড়ের বাংলা পোস্টার ও সাইনবোর্ডগুলোতে। এমনকি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক শহীদ মিনারে বিষ্ঠা পর্যন্ত লেপন করে তারা। ত্রাস সৃষ্টির জন্য শহরের যেখানে-সেখানে বোমা নিক্ষেপ করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ডা. জিকরুল হকের নেতৃত্বে সৈয়দপুর থানা ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গড়ে ওঠায় বিক্ষুব্ধ বিহারিরা সংঘর্ষের পথ খুঁজতে থাকে। মানচিত্র খঁচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা জড়ানো জিপে এমএনএ আবদুর রউফ সৈয়দপুরে আসলে ক্ষুব্ধ অবাঙালি তরুণরা পতাকা ছিঁড়ে ফেলে এবং তাকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করে।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে বিহারিরা অফিস-আদালত, দোকানপাট, বসতবাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ায়। অন্যদিকে এদিনটিকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ পালন করে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। সারাদেশের মতো সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়, কাজি পাড়া, কুন্দল, নতুন বাবুপাড়ায় ওই দিন পাকিস্তানি পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করায় শহরজুড়ে শুরু হয় বিহারীদের তান্ডব। এদিন তারা হত্যা করে সাবেক ছাত্রনেতা নূরু,কুদরত, রেলওয়ে কারখানার আবদুল হাফিজ, রফিক, জামান, ছামাদ, ফয়েজ সহ কয়েকজনকে। শহরে অবরুদ্ধ বাঙালীদের উদ্ধারের জন্য সাতনালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহতাব বেগের নেতৃত্বে স্থানীয়রা লাঠিসোঠা নিয়ে এগিয়ে এলে, বিহারীদের পক্ষে এসে যোগ দেয় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের এক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য। মেশিনগানের গুলীতে শহীদ হন বেশ কয়েকজন। মাহতাব বেগের মাথা বর্শায় গেঁথে শহর প্রদক্ষিন করে বিহারীরা।
সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃকর্ণেল ফজল করিম ও টুআইসি মেজর আকতার, কৌশল করে মার্চ মাসের শুরুতেই বাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের শহরের বাইরে বিভিন্ন কাজে পাঠিয়ে দেয়। বাঙালী অফিসারদের মধ্যে শুধু ল্যাফটেনেন্ট আনোয়ার থাকেন ভেতরে। ৩১ মার্চ রাতে তাঁদের উপর আক্রমন শুরু হলে লেঃ আনোয়ারের নেতৃত্বে বাঙালী সৈন্যরা বের হয়ে এসে ফুলবাড়িতে ডিফেন্স নেন। বিভিন্ন দিকে ছড়ানো অন্যান্য বাঙালী অফিসার ও সৈন্যরাও এসে ফুলবাড়ি ডিফেন্সে জড়ো হন। বাঙালী পুলিশদেরকেও ২৫ মার্চ রাতেই নিরস্ত্র করে ফেলে পাকিস্তানীরা। ফলে শহরের ভেতর একেবারেই প্রতিরোধহীন হয়ে পড়ে।
এই সুযোগে ডাঃ জিকরুল হক সহ শহরের শতাধিক গণ্যমান্য মানুষকে গ্রেপ্তার করে, দু সপ্তাহ নির্যাতন শেষে ১২ এপ্রিল বালাইর খালে নিয়ে হত্যা করে। শহরের বাকী সব বাঙালী ও মাড়োয়ারীরা অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকেন। মাড়োয়ারীদের সব ঘর লুট হয়। বাঙালীদের ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা ও ধর্ষন চলমান থাকে। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অপরাধে হত্যা করে ছাত্রনেতা মুরাদের মা ও বোনকে। ভ্রমর ও কলি নামে দুজন ছাত্রলীগ কর্মীকে ধর্ষন শেষে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয় বিহারীরা।
১৪- ১৬ এপ্রিল, প্রায় ৪০০-৪৫০ বাঙালি রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্য করে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে এনে ১২০০-২৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার বিশাল আকারের বয়লার ও ফার্নেস চুলায় নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে।
ছোট্ট শহরে বেঁচে থাকা বাকী মানুষদেরকে সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়নের কাজে শারীরিক শ্রমদানে বাধ্য করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে গালিগালাজ করে এবং চাবুক দিয়ে পিটায়।
অনেকদিন কাজ করানোর পর মে মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে মাড়োয়ারীদের সব পুরুষকে(আনুমানিক দুইশো) ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অভুক্ত অবস্থায় রেখে দেয়। কয়েকদিন পর তাঁদেরকে জানায় ট্রেনে করে ভারতে পৌঁছে দেবে।
১৩ জুন ১৯৭১। চারটি বগির একটি ট্রেন। প্রথম দুটিতে পুরুষ। শেষের দুটিতে নারী ও শিশু। সব মিলিয়ে ৪৫০ জনের অধিক, সবাই মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের মানুষ। মুষলধারে বৃষ্টি। সৈয়দপুর স্টেশন পার হয়ে শহরের বাইরে গোলাহাটে হঠাৎ ট্রেন থেমে যায়। পুরুষদের একটি বগিতে প্রথম আক্রমন শুরু হয়। পাকিস্তানী সৈনিকেরা অস্ত্র হাতে ঘিরে থাকে আর বিহারীরা দা দিয়ে এক কোপে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। দ্বিতীয় বগি থেকে ৫০ জন লাফিয়ে পড়ে পালাতে চাইলে শুরু হয় গুলী বর্ষন। এঁদের মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত ২৩ জন প্রাণে বেঁচে গিয়ে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন আশেপাশের গ্রামে। গোলাহাটে শহীদ হন ৪১৩/৪৪৮ জন। এঁদের অর্ধেকের বেশী শিশু ও নারী। ভয়ংকর নৃশংস ভাবে তাঁদেরকে হত্যা করে বিহারী ও পাকিস্তানীরা।
এরপরও শেষ নয়। ১৯ আগস্ট শহর থেকে সাত কিমি দূরে কামারপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম আক্রমন করে ধর্ষন, লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। বিহারী অধ্যুষিত সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তান আর্মি।
১৬ ডিসেম্বর নয়। ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অপারেশনে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান আর্মি ও সশস্ত্র বিহারীদল। সেদিনও তাদের আক্রমনে শহীদ হন আরো দুজন- মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন ও মুমতাজ হোসেন।
সুত্রঃ
===
১। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, দশম খন্ড। মুনতাসীর মামুন
২। ল্যাফটেনেন্ট আনোয়ারের সাক্ষ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, নবম খন্ড।
৩। বেজনাথ সিনহানিয়ার সাক্ষ্য। যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ডাঃ এম এ হাসান
৪। নীলফামারী ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন। আহম্মেদ শরীফ
৫। মুক্তিযুদ্ধে রংপুর। মুকুল মুস্তাফিজ।
৬। ১৯৭১ : সৈয়দপুরের গণহত্যা। সালেক খোকন।