বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ছিল এক সময়ের গর্ব। শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা, শিক্ষা—সবকিছুর মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছিল নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। কিন্তু সেই শক্তির খাতটাই আজ নিজেই পঙ্গু, নিজেই অচল। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে খুলনা, বরিশাল, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলে যখন সন্ধ্যার দিকে পুরো অঞ্চল অন্ধকারে তলিয়ে গেল, তখন মানুষ শুধু আলো হারায়নি, হারিয়েছে আস্থা—রাষ্ট্র ও শাসনের ওপর। এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি দীর্ঘ মেয়াদী অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক চক্রান্ত, দুর্নীতি আর ভয়াবহ অবহেলার পরিণতি, যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত একটি অবৈধ, জবাবদিহিহীন এবং জনগণবিচ্ছিন্ন সরকার।
এই সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই প্রতিটি খাতে যেভাবে লুটপাট চালিয়েছে, বিদ্যুৎ খাত তার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী। মোহাম্মদ ইউনুসের সরকার নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে রাজনৈতিক চাঁটির হাতে তুলে দিয়েছে। প্রকৌশল জ্ঞান, টেকনিক্যাল অভিজ্ঞতা, বা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কোনো মূল্য নেই এখানে। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে কমিশনভোগী সিন্ডিকেট, যেখানে প্রকল্প অনুমোদন মানে লক্ষ লক্ষ টাকার বাণিজ্য। কে কত লুট করতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতাই এখন নীতিনির্ধারক।
সরকার মুখে বলে—বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নাকি বেড়েছে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, একটা সামান্য গ্রিড লাইনের গড়বড়েই অর্ধেক দেশ অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো ব্যাকআপ নেই, গ্রিডগুলো অত্যন্ত পুরনো, অবকাঠামো অদ্ভুতভাবে দুর্বল, এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক—এদের পরিচালনায় যারা বসে আছে, তারা এই খাতের মানুষই নয়। তারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর তল্পিবাহক, যারা বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঠেকাতে নয়, বরং ‘ঘটনার দায় কিভাবে চাপানো যায়’ সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
দেশে প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, এটি পূর্বানুমানযোগ্য ছিল। কিন্তু ইউনুস সরকারের কাছে এসব যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তারা কোনো আগাম প্রস্তুতি নেয়নি, কোনো বিকল্প গ্রিড সংযোগ তৈরি করেনি, আর গ্যাস ও জ্বালানির নিরাপদ সংস্থান তো দূরের কথা—বরং কয়লা খনির লুটপাট, এলএনজির দুর্নীতিতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পিডিবি, এনএলডিসি, ডেসা, ডেসকো—যেখানেই তাকানো হোক না কেন, সবখানে চরম অদক্ষতা, রাজনৈতিক নিয়োগ, আর লুটপাটের সংস্কৃতি। প্রকৌশলী হিসেবে যাদের কাজ হওয়া উচিত ছিল প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া, তাদের জায়গায় বসেছে ইউনুসের ‘বিশ্বস্ত’ মুখ। তারা জ্ঞান দিয়ে নয়, ফোনে নির্দেশনা নিয়ে দপ্তর চালায়।
শুধু ঘরবাড়ি নয়, বিদ্যুৎ না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাসপাতাল, ওষুধের সংরক্ষণ ব্যবস্থা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প, ব্যাংকিং সেবা, ইন্টারনেট, এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। ২৬ এপ্রিলের ঘটনায় বহু শিল্পাঞ্চলের উৎপাদন বন্ধ ছিল, হিমাগার নষ্ট হয়ে গিয়েছে, মোবাইল টাওয়ার ব্যর্থ হয়েছে, অনেকে ইনহেলার বা লাইফসাপোর্টের অভাবে আতঙ্কে ছিলেন। এই মুহূর্তেও যদি আরেকটি দেশব্যাপী ব্ল্যাকআউট হয়, বাংলাদেশের প্রশাসনের হাতে কোনো রিকভারি মেকানিজম নেই। আর এই ভয়াবহ বাস্তবতার মাঝেই ইউনুস সরকার চলছে “সব ঠিক আছে” মার্কা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে।
সত্যি বলতে, বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয় কেবল একখাতের সংকট নয়, এটি একটি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রতিফলন। যে সরকার ভোট ছাড়া ক্ষমতায় আসে, সে সরকারের কাছে জনগণের সার্ভিস ডেলিভারি কোনো অগ্রাধিকার নয়। যে সরকার অস্ত্রের ছায়ায় শাসন করে, তারা অবকাঠামো ঠিক রাখবে কেন? যে সরকার জনগণের টাকায় বিলবোর্ড বানায়, তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন বিনিয়োগ করবে? এই সরকারের কাছে বিদ্যুৎ মানে কেবল বড় বড় প্রজেক্টের ঘোষণা, বিদেশি ঋণ এনে ফিতা কাটা, আর সেই প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজি করে কোটিপতি হওয়া।
বিদ্যুৎ খাতে ব্যর্থতা মানে শুধু অন্ধকার নয়, এটি অর্থনীতির মৃত্যু, চিকিৎসা ব্যবস্থার ভাঙন, কৃষির ধস, শিক্ষার অচলাবস্থা। এই ধ্বংস কেবল ২৬ এপ্রিলের এক সন্ধ্যার ঘটনা নয়, এটি বছরের পর বছর ধরে চালানো অব্যবস্থাপনার এক ভয়াবহ ফল। এবং এটি এমন এক সরকারের হাতে ঘটছে, যার কোনো নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই, যাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, যারা জনগণকে নয়, বিদেশি কূটনীতিকদের সন্তুষ্ট করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই দখলদার সরকার আর কত কিছু ধ্বংস করবে? স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা—সব কিছু যখন পঁচে গেছে, এখন বিদ্যুৎও গেল। এরপর কী? পানি? খাদ্য? পরিবহন? নাকি স্রেফ মানুষের সাহসটাও তারা নিঃশেষ করে ফেলবে?