মহান মে দিবস-২০২৫ উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। ১৮৮৬ সালের ৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে সারাবিশ্বের শ্রমিকদের জন্য দৈনিক আট ঘন্টা শ্রমের সীমা আদায় করে নেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে হে মার্কেটে আত্মাহুতি দেওয়া শ্রমিকদের স্মরণে প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করে। কেবল ইতিহাস নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, সম্মানজনক পারিশ্রমিক, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য এই দিন গুরুত্বপূর্ণ এক স্মারক।
শোষিত মানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করে আসছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন শোষিত, বঞ্চিত ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। সব সময়ই তাঁর অবস্থান ছিল শোষণমূলক অর্থনীতির বিরুদ্ধে এবং শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন করেন এবং প্রথম মহান মে দিবসকে ‘শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি দিয়ে মে দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে মজুরি কমিশন গঠন করেন এবং নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছে। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইনকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করে। দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় কোন শ্রমিক স্থায়ীভাবে অক্ষম অথবা মৃত্যুবরণ করলে, জরুরি চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ ও দূরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য এবং শ্রমিকদের সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্যেও আর্থিক সহায়তা পেতে গঠন করেছিল বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছিল। পোশাকশিল্পের কর্মহীন এবং দুস্থ শ্রমিকদের সর্বোচ্চ তিন মাসের নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। সকল সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছিল। শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে জাতীয় শ্রমনীতি-২০১২, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০, জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩, বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা-২০১৫ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১৫ প্রণীত করা হয়েছিল । নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং কার্যক্রম সুদৃঢ় হয়েছিল। শিল্প-কারখানায় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছিল। শ্রমিক ভাই-বোনদের যেকোন সমস্যা সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক টোল ফ্রি হেল্প লাইন (১৬৩৫৭) চালু এবং শিল্প কারখানায় বিশেষ করে পোশাকশিল্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে গত ৫ই আগস্ট অবৈধ শক্তি ক্ষমতা দখলের পর সারাদেশের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের জীবন এক গভীর সংকটে পতিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমাদের শ্রমিক-কৃষকেরা, যাদের শ্রম ও ঘামে বাংলাদেশকে আমরা একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলাম। দেশবিরোধী এই অপশক্তির ষড়যন্ত্রে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লুট করে ভস্মীভূত করেছে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরী হারিয়েছেন। বেকারত্বের পাশাপাশি দ্রব্যমুল্যের অসহনীয় উর্ধ্বগতিতে শ্রমজীবীদের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কর্মরত শ্রমিকরা ঈদের সময়ও তাঁদের প্রাপ্য বেতন-বোনাস পাননি। অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলে তাঁদেরকে হত্যা করছে অবৈধ দখলদারদের পেটোয়া বাহিনী। অনেক শ্রমিক-কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জনে বাংলার শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে গড়ে উঠেছে একটি ঐতিহাসিক বন্ধন। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে স্বপ্নের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনার যে সংগ্রাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুরু করেছে, তাতে অতীতের মতোই শ্রমজীবী তথা শ্রমিক-কৃষকেরা হবেন অন্যতম শক্তি। তাদের রয়েছে সাহস, একতা ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। মহান মে দিবস আমাদেরকে এই লড়াইয়ের প্রেরণা জোগায়।
আজকের এইদিনে বাংলাদেশের সকল শ্রমিক ভাই-বোনদের জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামে এই অন্ধকার কাটবেই। আমরা আবার ফিরিয়ে আনবো সমৃদ্ধ সোনালী দিন।
মহান মে দিবস অমর হোক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। তারিখ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫