নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান), ১ মে ২০২৫: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার লেমুছড়ি ও দৌছড়ি এলাকায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (আরসা) সদস্যদের অস্ত্রসহ অবাধ যাতায়াতের খবর জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, আরসার সশস্ত্র সদস্যরা দিনদুপুরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসব এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আরসার এই নির্বিঘ্ন চলাফেরা একটি বিদেশি সশস্ত্র গোষ্ঠীর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ ও তৎপরতার ঘটনাকে সামনে এনেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আরসার সদস্যরা শুধু যাতায়াতই করছে না, বরং অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও করছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রীয় তদারকির ঘাটতি বা সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত বহন করতে পারে।
এদিকে ২৮শে এপ্রিল, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন যে, বাংলাদেশ সরকার আরাকান আর্মিকে সীমান্তবর্তী এলাকায় করিডোর প্রদান করছে, যা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে তাদের সশস্ত্র তৎপরতাকে সহায়তা করবে। তিনি নিয়ন্ত্রন হারানোর ৪ মাস পরে স্বিকার করেছেন যে ২৭১ কিমি বাংলাদেশ-রাখাইন সীমান্তের দখল এন্টি স্টেট গভমেন্ট, অর্থাৎ আরকান আর্মির দখলে। এই নিয়ে বিডিডাইজেস্ট এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২৯শে এপ্রিল।
এটি জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। গত ২৭ এপ্রিল বিডিডি’ প্রতিবেদনে লেখা হয়, বাংলাদেশ আরাকান আর্মির জন্য একটি করিডোর প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা জনগণের মতামত ছাড়াই কার্যকর হচ্ছে। কোন রাজনৈতিক দল, কোন জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পরামর্শ ছাড়াই ড ইউনুস ও আমেরিকান নাগরিক ড খলিলুরের একক সিন্ধান্তে এই করিডর দেয়া হয়েছে রাখাইন অধিকৃত আরকান আর্মিকে, যা মায়ানমারের জুন্তা সরকারের পরিপন্থী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কিছু বিশ্লেষকের মতে, রাষ্ট্রের সহযোগিতা বা নীরব সম্মতি ছাড়া কোনো বিদেশি সশস্ত্র গোষ্ঠীর এভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়। তারা প্রশ্ন তুলছেন, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কীভাবে এই ঘটনা থেকে অজ্ঞ থাকতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উদ্বেগজনকভাবে, এই ঘটনা নিয়ে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। স্থানীয় সূত্রের দাবি, লেমুছড়ি ও দৌছড়ি থেকে সংগৃহীত ছবিতে আরসার সশস্ত্র সদস্যদের উপস্থিতি স্পষ্ট হলেও, এই বিষয়টি জাতীয় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেনি। এই নীরবতা জনমনে আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
এ বিষয়ে সরকার বা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ বিডিডির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে হয়েছিল কিভাবে আরাকান আর্মির সীমান্ত লঙ্ঘন করে বান্দরবনে স্থানীয় উৎসবে অংশগ্রহন করেছিল। এতে বলা হয়, গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল আরসার সশস্ত্র সদস্যরা বাংলাদেশের সার্বভৌম সীমানা লঙ্ঘন করেছে।
আরাকান আর্মির তৎপরতা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যই নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সীমান্তে তাদের উপস্থিতি কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৯ সালে মিয়ানমার সরকার অভিযোগ করেছিল যে, আরসা বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে তৎপরতা চালাচ্ছে, যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
নাইক্ষ্যংছড়িতে আরসা বাহিনী ও বান্দরবনে আরকান আর্মির সশস্ত্র উপস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এই দুটিই রাখাইনে পরস্পর বিদ্রোহী গ্রুপ হিসাবে পরিচিত। এই ঘটনা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সরকারের স্পষ্ট নীতিগত অবস্থানের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে। একই সঙ্গে, আরাকান আর্মিকে করিডোর প্রদানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং জনগণের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া এই ঘটনা দেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।