।।মনজুরে খোদা তারিক।।
আমেরিকার সাথে ইউক্রেনের সেই মূল্যবান খনিজ সম্পদের মালিকানার চুক্তিটি হলো। ইউক্রেনের খনিজসম্পদের উপর নজর মার্কিনীদের আজকের নয় অনেক দিনের। কিন্তু তাদের সেটা হস্তগত করতে প্লট/ছক তৈরী করতে হয়েছে, অনেক বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তার জন্য নির্ধারিত সংস্থা-এজেন্সি-প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গও নিয়োজিত ছিল।
তাদের সেই প্লটের প্রথম অংকে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়াকোনোভিচকে অরেঞ্জ রেভ্যুলেশনের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়, তিনি রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেই আন্দোলনের মূলশক্তি ছিল ছাত্র-জনতা। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা তরুনদের মার্কিন সংস্থাগুলো রেজিমচেঞ্জের নকশায় প্রশিক্ষিত করেছে। তাদের পিছনে ব্যয় করা হয়েছে মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার। তাদের অনেকের হাতে অস্ত্রও তুলে দেওয়া হয়েছিল। অনেক স্নাইপার সেই অরেঞ্জ রেভ্যুলেশনের লাশের যোগান বাড়িয়ে- জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে ছাত্র-জনতাকে মাঠে নামিয়েছে।
আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের প্রশিক্ষিত করতে মার্কিন প্রতিষ্ঠান USAID, NED (National Endowment for Democracy), Open Society Foundationsসহ বিভিন্ন সংস্থা ধারাবাহিকভাবে তৎপর ছিল তা আজ প্রমাণিত।
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের ইউক্রেনীয়-কানাডিয়ান বংশদ্ভুদ অধ্যাপক ইভান কাচানোভস্কি মাঠ পর্যায়ের দীর্ঘ গষেণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, সেই কালার রেভ্যুলেশনে যে হত্যাকান্ডগুলো সংগঠিত হয়েছিল, তা ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্নাইপারদের পরিকল্পিত কাজ। তিনি আন্দোলনে নিহতদের আঘাতের স্থান, ধরণ ও বুলেট পরীক্ষা করে সেই তথ্যপ্রমান হাজির করেছেন।
এই বিষয়ে সেই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান ক্যাথরিন অ্যাশটন এবং এস্টোনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উরমাস পেইতের মধ্যে এক ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেই ফোনালাপেই সেই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হয়েছিল, যে সংবাদটি দ্য গার্ডিয়েনে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের হত্যার দায় তৎকালীন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ওপর নয়, বরং বিরোধী পক্ষের ওপর আরোপ করা হয়।
১১ মিনিটের এই ফোনালাপটি ইউটিউবে পোস্ট করা হয়েছিল। ফোনালাপে পেইত বলেন, তিনি শুনেছেন যে কিয়েভে পুলিশ ও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য যারা দায়ী, সেই স্নাইপাররা ছিলেন বিক্ষোভ আন্দোলনের উসকানিদাতা, না যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সমর্থক। উত্তরে অ্যাশটন বলেন: “আমি জানতাম না… ওহ আমার ঈশ্বর।”
২০১৪ সালে অভ্যুত্থান হলেও নানা ছক কষে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা হয়। এবং অন্তর্বর্তী সরকার ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের পরিকল্পিত নির্বাচনের মাধ্যমে জোকার অভিনেতা মার্কিন স্তাবক জেলেনস্কিকে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি বানিয়ে আনা হয়। তাঁর তিন বছরের মাথায় পশ্চিমাশক্তির উষ্কানিতে রাশিয়াকে যুদ্ধে টেনে আনা হয়। ইউক্রেনকে ফুসলিয়ে তাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে পরাশক্তি রাশিয়াকে ধ্বংস ও খন্ডবিখন্ড করতে চেয়েছিল কিন্তু ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তি সে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। মার্কিনীরা সেখানে তাদের বেকায়দা বুঝতে পেরে বিনিয়োগ তুলে আনতে ইউক্রেনের মূল্যবান গ্রাফাইট, টাইটানিয়াম ও লিথিয়ামের বিরল খনিজ সম্পদের দখল নিল।
কিন্তু ইউক্রেনের কি লাভ হলো? কোন লাভ হয়নি শুধু ক্ষতিই হয়েছে;
১। রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি প্রদেশসহ তাদের ভূমির প্রায় এক চতুর্থাংশ দখল করেছে।
২। ইউক্রেনের চারকোটি জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মানুষ দেশ ছাড়া ও উদ্বাস্তু হয়েছে।
৩। দেশের প্রধান-প্রধান শহর-নগর-বন্দর, শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে।
৪। বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি ও বিশাল ঋণের জালে আটকে গিয়েছে।
৫। যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রায় ৭০-৮০ হাজার সৈন্য প্রাণ হারিয়েছেন, এবং প্রায় দুই লক্ষ পঙ্গু ও আহত হয়েছেন।
মাটির উপরে যা ছিল তা তো রাশিয়ার সাথে যুদ্ধেই চলে গেল। তারপরো তাদের মাটির নীচে যে সম্পদ ছিল তাও ঋণের জালে আজকে মার্কিনীদের হাতে তুলে দিতে হলো।