ঢাকা, ৬ মে ২০২৫: আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয় সদস্যের একটি কূটনৈতিক দল চট্টগ্রামের র্যাডিসন হোটেল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রওনা দেয়। দলে ছিলেন মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ড্যারেল রিচার্ড রাসমুসেন, কৃষি অ্যাটাশে সারাহ গিলেস্কি, রোহিঙ্গা প্রতিক্রিয়ার জ্যেষ্ঠ মানবিক উপদেষ্টা লিন্ডসে হার্নিশসহ আমেরিকান রিজিওনাল সিকিউরিটি অফিস এবং বাংলাদেশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের অন্যান্য কর্মকর্তারা।
মার্কিন দলের এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন সরকারের পণ্য চালানের আগমন পর্যবেক্ষণ করা এবং পণ্যগুলো পার্টনার গুদামে স্থানান্তরের জন্য কনটেইনার খালি করার প্রক্রিয়া দেখা। মনিরুজ্জামানের সঙ্গে মাত্র ১০ মিনিটের একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠকের পর দলটি বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র, যেখানে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয়। এই সফরটি বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব এবং এর উন্নয়নে মার্কিন আগ্রহের প্রতিফলন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এই সফরটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নের জন্য বাণিজ্যিকভাবে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। ডিপি ওয়ার্ল্ড বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বন্দর পরিচালনা ও লজিস্টিকস কোম্পানিগুলোর একটি, যারা ৪০টিরও বেশী দেশে বন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এবং রয়েছে বিতর্ক।
জর্জ বুশের সাথে সম্পৃক্ত থাকা ডিপি ওয়ার্ল্ড আসলে ইউএস নেভি’র একটি ফ্রন্ট লাইন। এবং বিভিন্ন দেশে ডিপি ওয়ার্ল্ড এর অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। কেনিয়ায় বন্দর পরিচালনার কাজ পাবার জন্য ডিপি ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষকে কমিশন দিয়েছিল, সেনেগালের ডাকার পোর্টে কাজ পাবার জন্য ডিপি ওয়ার্ল্ড সেনেগালের প্রেসিডেন্ট এবিউলিউ ওয়েড এর ছেলে করিম ওয়েড কে বড় অংকের কমিশন দিয়েছিল, জিবুতির সরকার ডোরালেহ টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য ডিপি ওয়ার্ল্ডকে অবৈধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যকলাপের অভিযোগ এনেছে।
এছাড়াও ২০০৬ সালে ডিপি ওয়ার্ল্ডের পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি (পিএন্ডও) অধিগ্রহণের মধ্যে ছয়টি প্রধান মার্কিন বন্দরের (নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমোর, নিউ অরলিন্স এবং মিয়ামি) ব্যবস্থাপনা চুক্তি করেছিল। এটি মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দেয়, কারণ ডিপি ওয়ার্ল্ডের মালিকানা সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের হাতে এবং ৯/১১ হামলার সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিনিয়োগ কমিটি (CFIUS) চুক্তিটি অনুমোদন করেছিল, কিন্তু সমালোচকরা পর্যালোচনা প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অভিযোগ করেছেন যে এটি পর্যাপ্ত কঠোর ছিল না। এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগের উপর কংগ্রেসের বৃহত্তর তদারকির দাবি উঠেছিল। পরবর্তিতে সেই চুক্তি স্বচ্ছতার অভাবে বাতিল করে মার্কিন প্রশাসন।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ডিপি ওয়ার্ল্ডের এই বিনিয়োগের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, বিশেষ করে চীন এবং ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে।
ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব একটি ব্রিটিশ কোম্পানির হাতে দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে।
এই কাজটি পূর্বে জাপানি কনসোর্টিয়ামের জন্য নির্ধারিত ছিল, যারা ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জাপানি আর্থিক সহায়তায় এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লবিং করে আসছিল। এর আগে জাপান বিমানবন্দর টার্মিনাল কোম্পানি, সুমিতোমো কর্পোরেশন, সোজিৎজ, নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্পোরেশন, সোজিৎজ কর্পোরেশন জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানি এবং জালাক্স ইনকর্পোরেটেডের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাপানি কনসোর্টিয়ামকে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ দেওয়ার কথা ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিমান বন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মান করেছিল জাপানের মিতসুবিশি কোম্পানি ও কোরিয়ার স্যামসাং কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম। সেই বলয় ভেঙ্গে ইউনুস সরকার এই বিমান বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিতে যাচ্ছেন নতুন বৃটিশ কোম্পানিকে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে পশ্চিমা প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি টার্মিনাল উন্নয়নের জন্য নীতিগতভাবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১ জানুয়ারি ২০২৫-এ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৯৭৯ সালের একটি আইনের ধারা প্রয়োগ করে বন্দর শ্রমিকদের আন্দোলন, ধর্মঘট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা প্রকাশসহ বিভিন্ন কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই নির্দেশনায় সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সমালোচনা, ক্ষোভ প্রকাশ, বা বন্দরের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, কর্মচারীদের মধ্যে “বিচ্ছিন্নতা” বা “শত্রুতা” ছড়ানোর অভিযোগে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা এই নির্দেশনাকে শ্রমিকদের অধিকার হরণের প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন, এটি বন্দরের উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করার জন্য সরকারের একটি কৌশল। অন্যদিকে, সরকারের দাবি, এই পদক্ষেপ বন্দরে পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত বন্দরগুলোর একটি, এবং এর কৌশলগত অবস্থান এটিকে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। মার্কিন কূটনীতিকদের এই সফর এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের সম্ভাব্য বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, এই পদক্ষেপগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রম অধিকার এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।