।। আলি শরিয়তি।।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি ও বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অপরিসীম অবদানের কারণে। তিনি শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়—সামাজিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ইতিহাসের কঠিন বাঁকে দাঁড়িয়ে বারংবার প্রমাণ করেছেন যে, নেতৃত্ব মানে শুধুই ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া নয়—বরং দুঃসময়কে সাহসের সাথে মোকাবেলা করা, সমগ্র জাতিকে সম্মিলিতভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং দেশের মানুষের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে অদম্য নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার সাথে কাজ করা। তাই তিনি ২০২৪ সালে দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র, অসত্য, ভিত্তিহীন প্রচারণা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার উত্তাল সময়ে কেবল দেশের স্থিতিশীলতা ও জনগণের মঙ্গলের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা ক্ষমতার মোহে নয়, বরং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এক দূরদর্শী নেতার মতোই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং প্রয়োজনবোধে দেশের বাইরে অবস্থান নেন, যেন তাঁর উপস্থিতি কোনো অনাকাঙ্খিত বিশৃঙ্খলার কারণ না হয়। এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে, নানান প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তবে যুক্তির আলোয় এবং দেশপ্রেমের পরিমাপে বিচার করলে স্পষ্ট হয়—শেখ হাসিনা যে পথ বেছে নিয়েছেন, তা ছিল রাষ্ট্রের শান্তি, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও জনগণের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য একটি দায়িত্বশীল, সাহসী ও আত্মত্যাগমূলক সিদ্ধান্ত। একমাত্র প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কই এমন নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করতে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেন।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, চেতনা ও আদর্শের ছায়ায় তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর প্রারম্ভিক রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয় ছাত্রজীবনেই, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
পারিবারিক আবহ, পিতার সংগ্রাম ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বঞ্চনা তাঁর মননকে শাণিত করে তোলে। সেই অনুপ্রেরণায়, তিনি ধীরে ধীরে পিতার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভাবতে শুরু করেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতার মতো, একজন দায়িত্বশীল বঙ্গ-কন্যার মতো। তবে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর অভিষেক ঘটে ১৯৮১ সালে, যখন তাঁকে নির্বাসনকালেই আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়—একটি ভগ্নপ্রায় দলের হাল ধরার মহান দায়িত্বটিই তিনি পালন করেন।
সে সময় আওয়ামী লীগ ছিল নেতৃত্বশূন্য, অভ্যন্তরীণ বিভাজনে বিপর্যস্ত এবং স্বৈরশাসনের দমন-পীড়নে জর্জরিত। দেশে সামরিক শাসনের কঠোর ছায়ায় গণতন্ত্র ছিল বিপন্ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল ছিন্নভিন্ন, আর বিরোধী দলগুলোর ওপর চলছিল অব্যাহত নির্যাতন ও নিপীড়ন। এমন এক ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাসিত জীবনের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা ছিল এক দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত—একটি পাহাড়সম বাধা পেরিয়ে স্বাধীনতার পতাকাবাহী দলের হাল ধরার অঙ্গীকার। কিন্তু তিনি সেই পথ বেছে নেন, কারণ তাঁর রক্তে ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, তাঁর হৃদয়ে ছিল দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার। সমস্ত ভয়-আশঙ্কা, ষড়যন্ত্র ও হুমকিকে উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং যান্ত্রিক রাজনীতির সেই বিমর্ষ মঞ্চে প্রাণের সঞ্চার করেন। দলকে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন, ভগ্নপ্রায় সংগঠনকে নতুন জীবন দেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা—জনগণের হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে আনেন নিজের দৃঢ়তা, সততা ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। সময়ের সাথে সাথে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের রাজনীতিতে এক অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্ব—যাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল গণমানুষের সাহস, আশা ও ভরসার প্রতীক।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে শেখ হাসিনা ছিলেন স্বৈরতন্ত্রবিরোধী গণআন্দোলনের অগ্রগামী কণ্ঠস্বর—একজন সংগ্রামী নেত্রী, যিনি জনগণের ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায্য জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার, অর্থাৎ “ভোট ও ভাত”-এর জন্য রাজপথে লড়েছেন নিরন্তর। তাঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল এক গভীর সামাজিক ও নৈতিক জাগরণের প্রতিফলন—যেখানে মানুষের অধিকার, সম্মান ও গণতন্ত্রের ভিত্তি পুনঃনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা লুকায়িত ছিল।
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ১৫ দলীয় জোট গঠন করে একটি সর্বদলীয় গণঐক্যের ভিত্তি তৈরি করেন। চরম দমন-পীড়নের মধ্যেও তিনি দৃঢ়চিত্তে রাজপথে থেকেছেন, কখনো আপস করেননি, পিছপা হননি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের যে পুনরুদ্ধার ঘটে, তার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন শেখ হাসিনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—এই সংগ্রাম কেবল এক নেত্রীর রাজনৈতিক কৃতিত্ব নয়, বরং এটি ছিল জাতির মুক্তির ইতিহাসে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের ইতিহাসে এক নবতর ধারার সূচনা করেন। তাঁর সরকারের সময় কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি, শিক্ষা খাতে বিশেষ করে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং তথ্যপ্রযুক্তির সূচনা—এসব উদ্যোগ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দৃঢ়তর করে তোলে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে “ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ” কর্মসূচির শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় তাঁর সরকার দক্ষতার সঙ্গে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করে প্রশংসিত হয়। এই মেয়াদে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়কসুলভ নেতৃত্বের প্রমাণ রাখেন।।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একাধিক ঐতিহাসিক অর্জনের সাক্ষী হয়েছে। ১৯৯৭ সালে তাঁর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। ২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় কার্যক্রম সম্পন্ন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বন্দী জীবনে থাকা মানুষদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দক্ষতায় ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা নদীভিত্তিক পানি বণ্টনে একটি স্থায়ী কাঠামোর সূচনা করে। এছাড়া আওয়ামী লীগকে ‘নাস্তিকতার দল’ হিসেবে যারা অপবাদ দিত, শেখ হাসিনা তাদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা, দেশের ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংবিধানসম্মত ধর্মীয় অধিকার রক্ষার অঙ্গীকারের মাধ্যমে দলকে সেই অপবাদ থেকে মুক্ত করেন। তাঁর এই দূরদর্শী নেতৃত্ব বাংলাদেশের শান্তি, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় অসামান্য অবদান রেখেছে।
২০০১ সালে নির্বাচনে দলটি ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে দেশে শুরু হয় নেতিবাচক রাজনীতি, যা স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের বিরোধী এক অন্ধকার যুগের দিকে প্রবাহিত হয়। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত দেশে দুঃশাসন চলতে থাকে, যেখানে রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে এবং রাজনৈতিক সহিংসতা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পক্ষে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ এবং রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাঁর সাহসিকতা ও নেতৃত্বে তিনি সমাজে পরিবর্তনের এক শক্তিশালী আন্দোলন সৃষ্টি করেন। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখনও তাঁর জনপ্রিয়তা এক চমকপ্রদ উচ্চতায় পৌঁছায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে বিশাল বিজয় অর্জন করেন, যা দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। এ বিজয়ের পর থেকেই শুরু হয় শেখ হাসিনার শাসনের দ্বিতীয় পর্ব—যার মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন, প্রযুক্তির বিপ্লব এবং দেশের রাজনৈতিক দৃঢ়তা।
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে, যা বিশ্বের অনেক দেশকে বিস্মিত করেছে। তাঁর নেতৃত্বে মাথাপিছু আয় তিনগুণের বেশি বেড়েছে, আর দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে প্রায় ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে—এটি দেশের ইতিহাসে এক বড় সাফল্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫,০০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২৫,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, যা দেশের শিল্প খাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সরকারের সময়েই বাস্তবায়ন হয়েছে একাধিক মেগা প্রকল্প, যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র—এই সমস্ত প্রকল্প সম্পূর্ণ দেশিয় অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে, যা একটি মধ্যম আয়ের দেশের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের (Economic Nationalism) ধারায় তিনি দেশীয় শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করেছেন, একই সঙ্গে তৈরি পোশাক, ওষুধ ও প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর সরকারের উদ্যোগে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের মধ্যে সুমহান সমন্বয় সৃষ্টি করেছে। তিনি ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-এর মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি, প্রগ্রেসিভ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, যা দেশের জলবায়ু-সহিষ্ণু উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় তাঁর অবদানকে সারা বিশ্ব সম্মানিত করেছে, এবং আজ বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে একটি মডেল দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও ঘাতকদের বিচারের পথ সুগম হয়। একই সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারও সম্পন্ন হয়। এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাসের দায় মেটানোর ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিচারহীনতার সংস্কৃতি (Culture of Impunity) থেকে বের হয়ে আসার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলো নারীর ক্ষমতায়ন। তাঁর নেতৃত্বে নারী শিক্ষা, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। নারী শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, রাজনৈতিক পদে নারী কোটা এবং প্রশাসনে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে—এ সকল পদক্ষেপ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নারী ইউএনও, ডিসি, এসপি, সচিব এবং সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির আসনে নারীদের নিয়োগ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা দেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এছাড়াও, ভূমিহীনদের মাসিক অনুদান, গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণ এবং সামাজিক সেফটিনেটের আওতায় বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার উদ্যোগ দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাঁর এই উদ্যোগগুলির প্রশংসা করেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন; যিনি তাকে কল্যাণমূলক অর্থনীতির এক অনন্য রূপকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা শুধু একটি মানবিক দায়িত্বই পালন করেননি, বরং বিশ্ববাসীর কাছে মানবিকবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে তিনি বারবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, মানবিক কূটনীতির মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড়িয়ে আছে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই নীতিতে। তিনি কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব ও রাশিয়ার সঙ্গে উন্নয়নমূলক সহযোগিতা বজায় রেখেছেন, এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালীন অনেক সাফল্য থাকলেও কিছু গুরুতর সমালোচনা এবং ব্যর্থতা রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফত মজলিশের মতো গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোষমূলক আচরণ, অনুগত নেতাদের বারবার পদ দেওয়া, প্রশাসনে দলীয়করণ এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন—এগুলো গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রতি প্রশ্ন তুলেছে। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, এবং দুর্নীতি দমন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। আরও একটি বড় সমস্যা হলো, গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার সংকোচন, যেখানে সাংবাদিকদের ওপর হুমকি-ধমকি এবং সেন্সরশিপের অভিযোগ উঠেছে। এসব ব্যর্থতা দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও সন্দেহ নেই, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি শুধু একজন সফল প্রধানমন্ত্রী নন, একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক—যিনি একাধারে সংগ্রামী কন্যা, মমতাময়ী মা, দূরদর্শী নেত্রী এবং মানবতার কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশকে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও আত্মমর্যাদার পথে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে তাঁর অবদান যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় থাকবে। দেশ আজ আবারো এক কঠিন মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে। বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের মানচিত্রে থাবা বসিয়েছে, আর আমাদের ভূখণ্ড আজ এক কঠিন সংকটের মুখোমুখী। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সীমানা সম্প্রসারিত হলেও, আজ স্বাধীনতার প্রতি যে হুমকি দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের বিকল্প নেই। দেশের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তাঁর অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামী মনোভাবের অধীনে আমরা যেন আবারও দেশপ্রেমের চেতনায় সঠিক পথপানে প্রাগ্রসর হতে পারি—এটিই বর্তমান অবস্থায় সময়ের সবচেয়ে বড় চাহিদা।
লেখকঃ রাষ্ট্রচিন্তক