“একবারে মরবো, বারবার না”
।। মাহমুদা খাঁ।।
“মুল্লুক চলো”ঐতিহাসিক স্লোগানটি শুধু একটি বাক্য নয় তাতে লুকিয়ে ছিল এক জাতির জেগে ওঠার চিৎকার, ইতিহাস বদলের দৃপ্ত শপথ।
বাংলার পাহাড়ি ভূখণ্ডে, চা পাতার কোমল সুবাসে ঢাকা পড়ে থাকে যে নীরবতা, সেখানে লুকিয়ে রয়েছে এক শতাব্দী পেরোনো রক্ত-ঘামের বিদ্রোহের গল্প “মুল্লুক চলো” আন্দোলন। আজ সেই মহাকাব্যিক সংগ্রামের ১০৪ বছর। অথচ আজও যেন সেই হাহাকার বেঁচে আছে চা বাগানের প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় চা শিল্পের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হলেও এ কাহিনি শুধুই চায়ের সুবাস আর সবুজ চরণচিহ্নের নয় এটি হাজারো শ্রমিকের চোখের জলের ইতিহাস। ভারতের আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র, নিম্নবর্ণের মানুষদের ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা ফেঁসে গিয়েছিল উপনিবেশিক শোষণের অবলম্বনে দাসত্ব, অনাহার, অনিশ্চয়তা ও অপমানের এক দুঃসহ চক্রে। নামমাত্র মজুরি, মানবেতর বাসস্থান, চিকিৎসাহীনতা আর অপুষ্টির অভিশাপে তাদের জীবন ছিল এক দীর্ঘ শ্বাসরুদ্ধ বন্দিত্ব। একসময় সেই বঞ্চনার আগুনেই জ্বলে ওঠে আন্দোলন।
১৯২১ সালের ৩ মার্চ প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক একজোট হয়ে সাফ জানিয়ে দেন আর না, এবার ফেরত যাব নিজেদের মাটিতে, নিজেদের ‘মুল্লুকে’। নেতৃত্বে ছিলেন পণ্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওশরণ। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে স্ত্রী- সন্তানসহ রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে রওনা দেন তারা। গন্তব্য চাঁদপুর ঘাট, সেখান থেকে জলপথে কলকাতা হয়ে নিজভূমে ফেরার প্রচেষ্টা। এই যাত্রা ছিল প্রতিকূলতায় পূর্ণ কিন্তু দৃঢ়তায় অনড়। হবিগঞ্জে পৌঁছালে কংগ্রেস নেতা শিবেন্দ্র বিশ্বাস ও বিপিনচন্দ্র পাল এবং অনেক কমিউনিটিরাও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এ যাত্রায় অনেকেই পথেই প্রাণ হারান। তবুও থেমে যায়নি সেই কাফেলা। চাঁদপুর পৌঁছে শুরু হয় বিভীষিকা। অর্থের অভাবে জাহাজে উঠতে না পেরে শ্রমিকরা জেটিঘাটে অপেক্ষা করছিলেন। বিশৃঙ্খলার মধ্যে পুলিশ গুলি চালায়। শ্রমিকদের লাশ ভেসে ওঠে মেঘনার জলে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে সেই রাতেই ২০ মে। প্রায় ৩-৪ হাজার শ্রমিক ঘুমিয়ে ছিলেন চাঁদপুর রেলইয়ার্ডে। গভীর রাতে গুর্খা বাহিনী ঘিরে ফেলে এলাকা। কমিশনার কে.সি. দে-র নির্দেশে শুরু হয় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ঘুমন্ত শ্রমিকদের কচুকাটা করা হয়, লাশ গুম করে ফেলা হয় নদীতে, বালির নিচে। কোনো পরিসংখ্যানে নেই সেই রক্তের হিসাব।এই গণহত্যার প্রতিবাদে চাঁদপুরে শুরু হয় হরতাল। ধর্মঘটে রেল ও জাহাজ কর্মীরা অংশ নেন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জেলাগুলোতে। ৪৫০০ রেলকর্মী চাকরিচ্যুত হন এবং ৬ সপ্তাহ ধরে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে। হারাধন নাগের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘রিলিফ কমিটি’, যারা অনাহারে ক্লান্ত শ্রমিকদের জন্য খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।এই আন্দোলনের মহান নেতা পণ্ডিত গঙ্গা দয়াল দীক্ষিত গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় অনশন করেন এবং সেখানেই শহিদ হন। তাঁর আত্মোৎসর্গ ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের চেতনায় অমর হয়ে আছে।
কিন্তু ১০৪ বছর পেরিয়ে আজ আমরা কোথায়?
২০২৫ সালে এসেও চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা। এই ১৭০ টাকায় চা শ্রমিকের নুন আনতে অয়ান্তা ফুরায়। প্রতিদিন ২৩ কেজি চা পাতা না তুললে সেই মজুরিও জোটে না। ২০২৪ সালে ঘোষিত ৫% মজুরি বৃদ্ধির বাস্তবায়ন এখনোও অনিশ্চিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ এর মতে, সিলেট অঞ্চলের ৭৪% চা শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। একটি কামরায় গাদাগাদি করে বাস করে ১০-১২ জন। সাপ্তাহিক খাদ্য বরাদ্দ সামান্য, অনেক ক্ষেত্রে চালের বদলে দেওয়া হয় নিম্নমানের ময়দা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোর দুর্দশা ও সামাজিক অবজ্ঞার কারণে শিক্ষার আলো শিশুদের কাছে পৌছায় না। অধিকাংশই স্কুল ছাড়ে অষ্টম শ্রেণির আগেই। অধিকাংশ বাগানে নেই অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি চিকিৎসা প্রায় দুর্লভ এবং অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়, যেখানে সাধারণ নারী শ্রমিকেরা ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান, সেখানে চা শ্রমিকদের জন্য তা মাত্র ৪ মাস যা একটি সুস্পষ্ট আইনগত বৈষম্য।
চা বাগানের শ্রমিকরা, যারা একদিন শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিলেন, তাদের উত্তরসূরিরা আজও হাঁটছেন তবে প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে। অভাব, অনাহার, অবহেলা আর অবজ্ঞার কাঁটাঝোপে জর্জরিত হয়ে। “মুল্লুক চলো” কেবল একটি দিন নয়, এটি এক যাত্রাপথ স্বপ্নের, সম্মানের, স্বাধিকারের। তাই প্রশ্ন রয়ে যায় ১০৪ বছর পরও যদি চা শ্রমিকদের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন না আসে, তবে স্বাধীনতা কাদের জন্য?আর যদি চা পাতার কোমল সুবাসের আড়ালে আজও লুকিয়ে থাকে ক্ষুধার দীর্ঘশ্বাস তবে ‘মুল্লুক চলো’র চেতনা কি পূর্ণতা পেয়েছে?
লেখক: চা শ্রমিক সংগঠক, এক্টিভিষ্ট ও উন্নয়ন কর্মী