ঢাকা, ২১শে মে, ২০২৫- দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং মানবিক করিডোর ইস্যু নিয়ে সেনাপ্রধান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে কিছুদিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। একের পর এক বৈঠক এবং মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের মধ্যস্থতা শেষে আজ সকালে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে দরবারে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি বলেন, “আমার কোনো অভিভাবক নেই, তোমরাই আমার অভিভাবক।”
বিগত কিছুদিন ধরে সেনাসদর, যমুনা ও বঙ্গভবন নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। এসব গুজবের কারণে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ওরফে রজার রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উপর চাপ বাড়ছিল। পিএসও কামরুল হাসানও এই চাপ থেকে মুক্ত ছিলেন না।
এই উত্তেজনার সূচনা হয় সেনাপ্রধান ওয়াকারের অনুপস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উচ্চপদস্থ মার্কিন নাগরিক খলিলুর রহমানকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সামরিক বাহিনীর বাইরের কেউ জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব পান। এই নিয়োগের পর মায়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মিকে দেওয়া “মানবিক করিডোর” ইস্যুটি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিব মানবিক করিডোরের প্রস্তাব দেওয়ার পর এপ্রিলের শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদুর রহমান প্রথম এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, “মানবিক করিডোর ইস্যুতে আমরা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছি এবং কিছু শর্ত আরোপ করেছি।” এরপর প্রেস সেক্রেটারি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে এই ইস্যুতে কথা বলেন, কিন্তু তাদের বক্তব্যে সামঞ্জস্যের অভাব ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে অসমর্থিত তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে টকশোতে বিভিন্ন খবর ছড়িয়ে পড়ে। দেশবাসী অপেক্ষায় ছিল মাতৃভূমির সুরক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কী বলে, তার জন্য। আজ সকালে দরবারে সেই অপেক্ষার অবসান হয়।
মানবিক করিডোর ইস্যুতে জেনারেল ওয়াকার সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, “নো ব্লাডি করিডোর বিজনেস।” এই ইস্যুতে তিনি কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। সকল সেনা সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানরা তার এই অবস্থান সমর্থন করেন।
দরবারে সেনাপ্রধান ও সেনা সদস্যরা জাতীয় নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সেনাবাহিনীকে অন্ধকারে রাখার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেনাবাহিনীকে বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এসব সিদ্ধান্ত জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের নেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান তার পূর্বের বক্তব্য “ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন” পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে “ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে” এবং কেবলমাত্র একটি “নির্বাচিত সরকার” দেশের গতিপথ নির্ধারণ করবে, এমন প্রশাসন নয় যা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয় বা জবাবদিহিতা করেতে ইচ্ছুক নয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা ও ভাস্কর্য ধ্বংসের ঘটনায় কমান্ডিং অফিসাররা উষ্মা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় মর্যাদাপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংস আর কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। কমান্ডিং অফিসাররা বলেন “মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কোন আপস নয়”। বিগত দিনে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি শক্তির উত্থান এবং তাদের হুংকারের বিরুদ্ধে প্রত্যয়ের সাথে জবাব দেয় সেনাসদস্যরা
মব সন্ত্রাস প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেন, “সেনাবাহিনী অনেক ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখিয়েছে, এখন আর নয়। এখন থেকে দেশে মব সৃষ্টি করে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ আর দেওয়া হবে না।” সকলকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে হবে। আর কোন ছাড় দেয়া হবে না।
যে আশা আর আকাংখা নিয়ে দেশবাসী তাকিয়ে ছিল সেনাবাহিনীর প্রতি, তার পূর্ন প্রতিদান দেয়ার প্রত্যয় ব্যাক্ত হয়েছে সেনাপ্রধান ও সেনাসদস্যদের বক্তব্যে ও অবস্থানে।