রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন এক গভীর ব্যাধি, যাহা উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে। চরিত্র হনন বলিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো রাজনীতিকের মানসম্মান, খ্যাতি ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করিবার প্রয়াস ও প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এই প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন উপায়ে সম্পন্ন হইতে পারে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে আজকাল এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে। মিথ্যা মামলা দায়ের, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আদালতে হয়রানি, সর্বব্যাপী অপপ্রচার এবং তথাকথিত ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ ইত্যাকার পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করিয়া রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হয়। প্রায়শই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকেই সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়। এই সকল অপপ্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য হইল সংশ্লিষ্ট রাজনীতিককে জনগণের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করা, তাহাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বা নির্বাচনে অযোগ্য প্রমাণ করা এবং সর্বোপরি তাহার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় করিয়া তোলা। ইহা কেবল বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করিবার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, বরং অনেক সময় নিজ দলেও অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে এমন কাণ্ড ঘটিতে দেখা যায়।
এই চরিত্র হননের ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং ভয়াবহ। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে ইহার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চরমে উঠে, সহিংসতা বৃদ্ধি পায় এবং জনজীবনে এক অনিশ্চয়তা ও ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। যখন কোনো রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় এবং অবিরাম অপপ্রচার চালানো হয়, তখন জনগণের মধ্যে তাহাদের প্রতি সৃষ্টি হয় আস্থাহীনতা। ইহার ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ হ্রাস পায় এবং যোগ্য নেতৃত্ব বিকশিত হইবার পথ রুদ্ধ হয়। দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হইবার পাশাপাশি বিদেশেও তাহাদের সম্মানহানি ঘটে। যখন কোনো রাজনীতিক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করিতে কিংবা বিদেশ ভ্রমণে যান, তখন বিমানবন্দরসহ অফিস-আদালতে তাহার নাম দিয়া ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করিলেই তাহার সম্পর্কে নানা সত্য-মিথ্যা তথ্য বাহির হইয়া আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সকল তথ্য শুধু ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করে না, বরং তাহার দেশ সম্পর্কেও বিদেশিদের মনে তৈরি করে বিরূপ ধারণা। সত্য-মিথ্যা মিলাইয়া এই যে নাম দাগা হয়, তাহা নিঃসন্দেহে বিদেশিদের নিকট ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করিয়া থাকে। তাহারা বিশ্বাস হারান। বিনিয়োগ, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক ভাবমূর্তি দেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। ফলে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশ কোণঠাসা হইয়া পড়ে এবং উন্নয়নের পথ আরো কঠিন হইয়া উঠে।
এই ভয়াবহ চক্র হইতে পরিত্রাণ লাভ করা উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে, ইহা অসম্ভব নহে। প্রথমত, এই জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। যে করিয়াই হউক, ঢালাও, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা রোধ করিতে হইবে এবং রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধ করিবার জন্য কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল হইতে হইবে। নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন এবং তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হইবে। বিচারাধীন মামলার ক্ষেত্রে এই সতর্কতা সবচাইতে জরুরি। এই জন্য তথাকথিত ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বন্ধ করিবার জন্য কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করিতে হইবে। জনগণকে মিথ্যা তথ্য যাচাই করিতে এবং গুজবে কান না দিতে উৎসাহিত করিতে হইবে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করিতে হইবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও গঠনমূলক সমালোচনার সংস্কৃতি গড়িয়া তোলা প্রয়োজন। শিক্ষিত ও সচেতন জনতা এই সকল অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিতে পারে।
ইত্তেফাক/এমএএম