।। ড. মামুনুর রশীদ।।
গত ১৫ বছর বাংলাদেশে দেশবিরোধী শক্তি – যারা এখন ক্ষমতা দখল করেছে – ক্রমাগত শেখ হাসিনা, তার দল আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে এই বলে যে শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে রেখে পালিয়ে গেছেন।
আসলেই কি তাই? আসুন ডাটা দিয়ে দেখি।
নিচের চিত্র থেকে আপনি চারটা দেশের ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত পাবেন ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত। এই ঋণ ফিনান্সিয়াল সিস্টেম থেকে সরকারের নেয়া ঋণ। এই চারটা দেশ হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া। ফিগারগুলো দেয়া হয়েছে অনুপাতে (%)। তথ্যগুলো বাংলদেশ ব্যাংকের সাথে ম্যাচ করে সঠিক পাওয়া গেছে।
প্রথমেই সরকারের ঋণ এবং জিডিপি সম্পর্কে কিছু কথা। একটা দেশে এক বছরে যে সকল পণ্য এবং সেবা তৈরি হয় তাকে [Gross Domestic Products (GDP)] জিডিপি বলে। তার মানে আপনার যত প্রোডাকশন হবে, তত জিডিপি বাড়বে। আর প্রোডাকশন করতে ইনভেস্টমেন্ট দরকার, যার জন্য দরকার টাকার। নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে হাজার কোটির ইনভেস্টমেন্ট কেউ করে না। এইজন্য ফিনান্সিয়াল সিস্টেম (ব্যাংক এবং স্টক মার্কেট) থেকে ঋণ নেয়া হয়।
সরকার ঋণ নেয় কিছুটা ভিন্ন কারণে। সরকারের ঋণের কারণ প্রধানত তিনটি।
১) বিনিয়োগ অবকাঠামো নির্মাণ
২) সামাজিক সুরক্ষা এবং সামাজিক সেবা প্রদান
৩) সরকার চালানোর খরচ
সরকারের আয়ের “প্রধান” উৎস ট্যাক্স। দুনিয়াতে সব সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এইজন্য দুনিয়াতে সবদেশে ব্যাংক এবং স্টক মার্কেট থেকে সবচেয়ে বেশি (কোনো কোনো দেশে ৫০% এর বেশি) ঋণ নেয় সরকার। সরকারের এই ঋণ উপরে বর্ণিত কাজে ব্যবহার হয়।
সরকারের উচ্চ ঋণ নেয়ার কারণে নিচের তিনটা বিষয়ে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হতে পারে।
১) ব্যক্তি এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোন কমে যাবে
২) মার্কেটে টাকা কমে গেলে ঋণের হার এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে
৩) সরকার দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে

কিন্তু এই ঋণের কোনো সীমা নেই। আমেরিকাতে ১২২% হচ্ছে ঋণ-জিডিপি অনুপাত। তারমানে ১০০ ডলার জিডিপির বিপরীতে ১২২ ডলার আমেরিকা সরকার ঋণ করেছে। ইন্ডিয়াতে এটা ৮২%, চায়না ৮১%, সিঙ্গাপুর ১৭৩% এবং জাপান ২৬৩%।
তাহলে উচ্চ ঋণের কারণে উপরের কোন দেশকে আপনারা এই পর্যন্ত সর্বস্বান্ত হতে দেখেছেন? একমাত্র আমেরিকা প্রতি বছর সরকারের ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বাড়ায় যা পুরো পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে। কিন্তু বাকি কোনো দেশের ক্ষেত্রে (বিভিন্ন কারণে) এই ঋণের খবর নিয়ে কেউ এতটা চিন্তিত নয়। এমনকি উপরের দেশগুলোর উন্নয়নের উদাহরণ টেনেই সরকারকে বিব্রত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কী অবস্থা? নিচের চিত্র থেকে দেখা যায় যে ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাকী তিনটা দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে ভালো ছিলো। শুধুমাত্র ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অনুপাত ৩৭.১% ভিয়েতনামের ৩৩.৫% এর চাইতে বেশি ছিলো।
এতে কী সুবিধা হয়েছে? বাংলাদেশ সরকার কম টাকা ধার করাতে, বাকি টাকা ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্জিক কাজে ঋণ দিতে পেরেছে। তার ফল হচ্ছে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়ে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন হয়েছে একই সময়ে।
রাস্তায় বেরুলেই যে ঝকঝকে চকচকে রাস্তাঘাট, মেট্রোরেল, সেতু-উড়ালসেতু দেখেন তা সম্ভব হয়েছে সরকারের এতো কম ঋণ নেয়ার কারণে।
তাহলে গত ১৫ বছর যা শুনেছেন তা মিথ্যা। প্রতারণা করে আপনার না জানার সুযোগ নিয়ে কিছু সন্ত্রাসী ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে মশকরা করছে। এই ধরনের একটা অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করার পরেও শেখ হাসিনা হলেন দুর্নীতিবাজ, আর যারা এখন আপনাকে লুট করছে তাদেরকে বলছেন দেশপ্রেমিক।
পরিচিতি: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক