।। সেলিম জাহান।।
এ রকমের বিদ্বেষের কারণেই পুরুষ নারীর স্বাধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, রোধ করতে চায় নারীকণ্ঠ, সীমিত করতে চায় তার স্বাধীন সত্তা এবং আত্মপরিচয়।
শেষ পর্যন্ত ‘সমতা’ বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘নারী-পুরুষের সমতা’ বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ অন্য সবকিছু বাদ দিলেও গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের মূলমন্ত্রই ছিল বৈষম্য নিরসন। সুতরাং আজ যদি নারী-পুরুষের সমতা অগ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের মূলমন্ত্র সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠে।
নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে হচ্ছে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতাকে সমর্থন করা। বিষয়টি শুধু শঙ্কার অথবা ক্ষুব্ধতার নয়, বিষয়টি আতঙ্কের। কারণ, এর পেছনে নারীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও সহিংসতা সুস্পষ্ট। এবং এই বিদ্বেষ ও সহিংসতা সমাজে ক্রমবর্ধমান। কিন্তু কেন?
বাংলাদেশের নারীরা জীবনের প্রতি পদে বৈষম্যের শিকার। অর্থনৈতিক বলয়ে কর্মক্ষম বয়ঃকালে অন্তর্ভুক্ত নারীদের মাত্র ১৪ শতাংশ কাজ করে। এবং তারা বেতন ও কর্মপদোন্নতি বৈষম্যের শিকার। যারা কাজ করছে, তাদের ৯২ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। দেশের ৭০ লাখ উদ্যোক্তার মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ নারী। প্রায় ৩০ শতাংশ নারী মজুরিবিহীন সেবাকর্মে নিয়োজিত।
এসব কাজে বেতন যেমন কম, তেমনি ঝামেলা অনেক। মাত্র ৩৬ ভাগ নারীর ব্যাংকে জমা আছে। বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের মেয়েদের সক্ষমতাকে নষ্ট করে। যদিও মেয়েদের আইনগত বিয়ের বয়স ১৮ বছর, তবু বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়। জীবনের কোনো না কোনো সময়ে বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৭৩ শতাংশ গৃহ-অভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হন।
আজকের বাংলাদেশে নারীর প্রতি সমতার বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়েছে, তা শুধু নারীর প্রতি বিদ্বেষ নয়। সেটা সমতার প্রতি বিদ্বেষ, মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, শুভবুদ্ধির প্রতি হুমকি।
নারীর প্রতি পুরুষের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং বিদ্বেষ বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ; বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র, চরম শ্রেষ্ঠবাদিতা, উগ্র মৌলবাদের বিস্তার, নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি ইত্যাদি। এ রকমের বিদ্বেষের কারণেই পুরুষ নারীর স্বাধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, রোধ করতে চায় নারীকণ্ঠ, সীমিত করতে চায় তার স্বাধীন সত্তা এবং আত্মপরিচয়।
প্রথমত, বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্রোধ ও যৌনতার মাধ্যমে। নারী যেখানে মনোবলে বলীয়ান, পুরুষ সেখানে দেহবলে বলীয়ান। দেহবলে বলীয়ান পুরুষ তার পেশিশক্তি প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে। দেহবলই পুরুষকে উন্মত্ত করে, যুক্তিবিবর্জিত করে, সংঘাতপ্রবণ করে তোলে। এ পুরো দ্বন্দ্বে পুরুষ নারীকে তার ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখে। অতএব এমন বাধাকে তো শৃঙ্খলিত করতেই হবে পুরুষকে। বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতা মানবকে দানবে পরিণত করে এবং পুরুষকে নারীবিদ্বেষী করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, নারী বিষয়ে পুরুষের একটি চরম শ্রেষ্ঠবাদী ধারণা কাজ করে। পুরুষ মনে করে যে সে সর্ব বিষয়ে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং তার অসাধ্য কিছু নেই। অন্যদিকে নারী জানে কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা। নারীর দুর্বলতা পুরুষের পরিহাসের বিষয়, আর তার শক্তি পুরুষের অস্বস্তির কারণ। জীবনধারায় নারী-পুরুষকে পরিপূরক হিসেবে দেখে, কিন্তু পুরুষ নারীকে দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।
সুতরাং সম্পূরক হতে পুরুষের প্রবল আপত্তি। এই উগ্র শ্রেষ্ঠবাদী মনোভাবের কারণে পুরুষ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য করে, তার বুদ্ধি–বিবেচনা নিয়ে পরিহাস করে, তার মনন ও চিন্তাকে খাটো করে। নারীর বাস্তববাদিতা ও যুক্তিনির্ভরতা অযৌক্তিক পুরুষকে ক্ষিপ্ত করে এবং তখন সে নারীকে বন্দী করার জন্য ব্রতী হয়।
তৃতীয়ত, বলার অপেক্ষা রাখে না যে নারীর পরিপ্রেক্ষিতে উগ্র মৌলবাদী চিন্তাচেতনা নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাকে সঠিক বলে মনে করে, নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে অনুমোদন করে এবং পুরুষকে নারীর ক্ষেত্রে ‘নৈতিক পুলিশের’ দায়িত্ব দেয়। আমাদের সমাজে এ–জাতীয় উগ্র মৌলবাদী চিন্তাচেতনা যত বিস্তার লাভ করবে, বিশেষত পুরুষের মধ্যে; ততই নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ববাদ, নিপীড়ন, নারীর স্বাধিকারের ওপর পুরুষের হস্তক্ষেপ বেড়ে যাবে।
তখন পুরুষ বলে দেবে কী পোশাক পরিধান করা নারীর উচিত, কোথায় কোথায় নারী যেতে পারবে, কী কী করার অনুমতি তার আছে। সেগুলোর কোনো লঙ্ঘন হলে যেকোনো পুরুষ শুধু পুরুষের অধিকারবলে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, নারীকে নিপীড়ন করতে পারবে, তাকে শাস্তি দিতে পারবে। নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি এই উগ্র শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।
এই বিদ্বেষ ও নারীকে আক্রমণ এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সমাজে বেড়েই চলেছে। সে আক্রমণ ও বিভিন্ন বলয়ে বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা রূপ নিচ্ছে দেহজ ও মানসিক নির্যাতনের; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণসহ নানা যৌন নিপীড়নের, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ আক্রমণের।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে ২০৫ জন নারী এবং কিশোরী নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা আছে ৬৭টি। পরের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে ১৮৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৪৮টি। বলা নিষ্প্রয়োজন যে বাস্তব ঘটনা প্রদত্ত এসব উপাত্তের চেয়ে অনেক বেশি।
আসলে বাংলাদেশের জন্য নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও সহিংসতা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে, এটা যেন আর ব্যতিক্রম নয়। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দায় স্বীকার করে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে শক্ত হাতে। নারীবিদ্বেষী চর্চাকে প্রতিহত করতে হবে যূথবদ্ধ ও সামাজিকভাবে। প্রতিবাদ ও প্রতিকার করতে হবে সবাই মিলে।
আজকের বাংলাদেশে নারীর প্রতি সমতার বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়েছে, তা শুধু নারীর প্রতি বিদ্বেষ নয়, সেটা সমতার প্রতি বিদ্বেষ, মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, শুভবুদ্ধির প্রতি হুমকি। সমতার সপক্ষে এ লড়াই আমাদের সবার এবং এ লড়াই লড়ার কোনো বিকল্প নেই। চূড়ান্ত বিচারে সমতার এ লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে।
● ড. সেলিম জাহান জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক