।। আলি শরিয়তি উবাচ।।
ভূমিকা
৫ আগস্ট থেকেই দেশে মব লিঞ্চিং নামে এক ধরণের পরিকল্পিত নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। ইউনূস সরকারের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে এই মবের মুল্লুকের যাত্রারম্ভ হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৯৮ জন মবোল্লাসে প্রাণ হারিয়েছে। এতে নিরীহ মানুষ যেমন আছে, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলিও হয়েছে অনেকে। পরিকল্পিতভাবে চোর বা ডাকাত বানিয়েও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা আছে, আছে সত্যিকারের ডাকাত-চোর হত্যার ঘটনাও। ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণের পরে হত্যার নজিরও সৃষ্টি হয়েছে। এ-এক দানবীয় বাংলাদেশের চিত্র। এমনটি আগে কেউ কখনও দেখেনি।
লিঞ্চিং হলো এমন এক ধরণের সহিংসতা, যেখানে একদল লোক আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কাউকে শাস্তি দেয়- কোনো বিচার বা প্রমাণ ছাড়াই। ‘লিঞ্চিং’ শব্দটি এসেছে চার্লস লিঞ্চ নামে একজন আমেরিকান ব্যক্তির নাম থেকে, যিনি আমেরিকায় বিপ্লবের সময় নিজের মতো বিচার করে মানুষকে শাস্তি দিতেন। বাংলাদেশে ইউনূস জমানায় মব লিঞ্চিং বা ক্রাইম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সঠিক ইতিহাস লেখা হলে হয়তো ড. ইউনূসের নাম হয়ে যাবে ড. ইউনূস লিঞ্চ!
২০২৪ সালের মব কিলিং এর খতিয়ানঃ
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় ১৪৬ জন মারা গেছেন। এতে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪২ জন, আর বাকী ১০৪ জনই ইউনূস শাহীর শাসনামলে নিহত হয়েছে। যা ২০২৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত ১০৪ জনের মধ্যে আগস্টে ২২ জন, সেপ্টেম্বরে ২৭, অক্টোবরে ২৩, নভেম্বরে ১৫ এবং ডিসেম্বরে ১৭ জন নিহত হয়েছে।
আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন, ২০২০ সালে ৩৫ জন, ২০১৯ সালে ৬৫ এবং ২০১৮ সালে ৩৯ জন।
এসব তথ্য উপাত্ত থেকেই উপলব্ধি করা যায়, দেশে কি পরিমাণ শান্তির সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে!
২০২৫ সালের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত মব কিলিং এর খতিয়ানঃ
জানুয়ারিতে ১৭জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৫, মার্চে ২২, এপ্রিলে ২৯ এবং মে মাসে ১৭ জন, অর্থাৎ মোট ১০০ জন নিহত হয়েছে।
গত বছরের শেষ পাঁচ মাসে মব কিলিং-এ হত্যার সংখ্যা ছিল ১০৪ জন, আর চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে হত্যার সংখ্যা ১০০ জন। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, মব কিলিং এর মাত্রা, তীব্রতা এবং সংখ্যা মোতেও কমেনি। সরকারের এই বিষয়ে ন্যূনতম নজর নেই। রাষ্ট্রের অন্যান্য সকল বিষয়ে যেমন নৈরাজ্য চলছে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
কয়েকটি কেইস স্টাডিঃ
সরকার বাহাদুর সকল নিহতের তথ্য প্রকাশ হতে দেয় না। মিডিয়ার টুটি চেপে রাখা না হলে আরও তথ্য পাওয়া যেতো। এরপরেও ইউনূস শাহীর আমলে মোট ২০৪ জনের হত্যার তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- চলমান পরিস্থিতিতে পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিজের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ও কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। এরমধ্যে অন্তত তিনটি ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল ও সমালোচনার ঝড় তোলেছিল। যথা-
কেইস স্টাডি-১
তোফাজ্জল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মধ্যে তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তোফাজ্জল ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক অবোধ যুবক। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে সে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ঢাকার সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা তোফাজ্জল হোসেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া খাবার গ্রহণ করতেন। দুনিয়াতে এতিম বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন। তাঁর আপন বলে পৃথিবীতে কেউ ছিল না। অবশেষে ঘাতকের কালো হাত তাকেও আপনজনদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। তোফাজ্জলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবদুর রহমান-বিউটি বেগমের উত্তরাধিকার বলতে আর কিছু রইল না নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে।
তোফাজ্জলের পিতা আব্দুর রহমান ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। একই বছর তার মা বিউটি বেগম ক্যান্সারে মারা যান। তার একমাত্র বড় ভাই নাসির উদ্দিন ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, দুঃখের বিষয় তিনিও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল মারা যান। মা, বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু শোকের কাতর তোফাজ্জল একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, প্রচলিত অর্থে পাগল হয়ে যায়। তাঁর চিকিৎসা বা সেবা শুশ্রূষার কেউ ছিল না। সহায় সম্পত্তি বলতেও তেমন কিছু ছিল না। এরকম একজন পাগলকে মোবাইল চুরির মিথ্যা অভিযোগ ও নাটক সাজিয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করা হয়। তোফাজ্জল হত্যার বিচার কতদূর?
একজন অসহায়, অসুস্থ মানুষকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন সাবজেক্টে পড়ুয়া একদল ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা আনন্দ-উল্লাস করতে করতে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলে। এমন অমানবিক, পাশবিক ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, তাও দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত হলো। এ লজ্জা রাখবে কোথায় বাংলাদেশ? এ বদনাম ঢাকবে কি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?
কেইস স্টাডি-২
আবদুল্লাহ আল মাসুদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী। তাঁকে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পিটিয়ে হত্যা করা। মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে ছাত্রশিবিরের হামলার হামলার শিকার হন আবদুল্লাহ আল মাসুদ। হামলায় মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাম পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল তাঁর হাতের রগ। অনেক চিকিৎসা করিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে একজন পঙ্গুর জীবন যাপন করতে হয় মাসুদকে। ওই হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। ছাত্রলীগ সম্মান জানিয়ে মাসুদকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে মনোনীত করেছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে ৭ তারিখে প্রথমে তাঁর ওপর হামলা করা হয়। মাসুদ সন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে দোকানে গিয়েছিল। সেখানেই হামলা চালিয়ে তাঁর অন্য পা ভেঙে দেওয়া হয়। গণপিটুনি দিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যায় হামলাকারীরা। কিন্তু মতিহার থানায় ৫ আগস্টের সহিংসতার কোনো মামলা ছিল না, তাই তাঁকে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে গিয়ে কোনো একটি সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য চাপ দেয়া হয়। অথচ গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছিল মাসুদ, তাঁকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে আগে মামলায় ফাঁসানোর ফন্দি করেছিল খুনিরা। বোয়ালিয়া থানায় মাসুদের শারীরিক অবস্থা দেখে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, চিকিৎসকরা শত চেষ্টা করেও জীবন সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। থানা থেকে হাসপাতালে নেওয়া হলে মধ্যরাতে তিনি মারা যান।
২০১৪ সাল থেকে পঙ্গু জীবন যাপন করা মাসুদ পড়ালেখা শেষ করলেও অসুস্থতার দরুন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর তাঁর দুর্দশার কথা বিবেচনা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাসুদকে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে চাকরি দেয়। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সেই থেকে মাসুদ এ পদেই চাকরি করছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় বসবাস করতেন। ৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে হত্যার মাত্র চারদিন আগে ৩ সেপ্টেম্বর মেয়ের বাবা হন মাসুদ। ৪ দিন বয়সী কন্যার জন্যই ওষুধ কিনতে দোকানে গিয়ে মবের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই কন্যা বেঁচে থাকলে বড় হয়ে জানবে তাঁর পিতা কোন অপরাধী ছিলেন না, একজন পঙ্গু ও অসুস্থ অসহায় পিতা ছিলেন, যিনি কন্যার অসুস্থতায় দিশেহারা হয়ে চরম প্রতিকূল পরিবেশেও ওষুধের জন্য জীবনবাজি রেখে বাইরে বেরিয়ে আর ঘরে ফিরতে পারেননি। জালিমেরা একজন পিতার ওপর জুলুম চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। মাসুদের বিধবা স্ত্রী বাকী জীবন কীভাবে পাড়ি দিবে তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
ইতোমধ্যে ৯ মাস চলে গেছে মাসুদের খুনিদের বিচারের কি হয়েছে? মাসুদের স্ত্রী আছে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও আছেন, নিশ্চয়ই মামলা চালিয়ে যাবার সুযোগ হবে। এক্ষেত্রে তোফাজ্জলের বড়ই দুর্ভাগ্য, এই দুনিয়ায় তাঁর কেউ নেই। অবশ্য যার কেউ নেই তাঁর আল্লাহ আছেন। মাসুদের সৌভাগ্য তাঁর একটি কন্যা আছে। আমরা স্মরণ করতে পাড়ি, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ খুন হয়েছিল। অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন পড়ে এখন হাইকোর্টের নিয়মিত আইনজীবী। কন্যার হাতে মামলা পরিচালনাতেই পিতার খুনিরা ফাঁসিতে ঝুলেছে। একদিন হয়ত মাসুদের কন্যাও এভাবে আইনজীবী হবে এবং পিতার খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কোর্টে লড়াই করবে।
কেইস স্টাডি-৩
শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শামীমকে শামীমকে তথাকথিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একদল শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেইটে ধরে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আহত অবস্থায় শামীমকে উদ্ধার করে প্রক্টরের কার্যালয়ে নিয়ে যান। কিন্তু এরমধ্যেই কতিপয় ছাত্র নামধারী খুনি প্রক্টরের কার্যালয় থেকে শামীমকে প্রক্টর কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত নিরাপত্তা কার্যালয়ে নিয়ে যায়। প্রক্টর বিষয়টি জানতে পেরে খুনি ছাত্রদের সরিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেন। কিন্তু আরও ছাত্র জড়ো হয়ে নিরাপত্তা কার্যালয়ের তালা ভেঙে শামীম মোল্লাকে আবারও মারধর করেন। এহেন মারধরের পরে আর বেঁচে থাকার সুযোগ থাকে? নাকি বাঁচিয়ে রাখতে এমন নির্মম নির্যাতন করা হয়? কোনোটাই নয়, শামীমকে মেরে ফেলতেই এভাবে বারবার মারধর করা হয় এবং শামীম মারা যায়। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাত আটটার দিকে শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়। আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে শামীমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত নয়টার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করে কর্তব্যরত চিকিৎসক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে মৃত্যুর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দফায় মারধর করা হয়। শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। মাসুদের মতো শামীমের মন্দ কপাল! যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে আড্ডা দিয়েছেন, বন্ধুদের সাথে মাঠে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলেছেন, ক্লাসে বসে লেকচার শুনেছেন, পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিয়েছেন; সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তাঁদের অনুজ ছাত্ররা, যারা খুনের নেশায় উন্মাদ, তাঁদের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের যেকোন ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। শামীম মোল্লার হত্যাকাণ্ডেও মিছিল, সভা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যা সাবেক ও বর্তমান ছাত্ররা করেছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বিচারের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
মন্তব্যঃ
আইনের শাসন তথা বিচারহীনতায় বাড়ছে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা। এসব হত্যার অধিকাংশই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেটা রাজনৈতিক বিরোধ থেকে যেমন ঘটছে, তেমনি জমি নিয়ে বিরোধ, অন্যান্য পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ নিয়েও মব সৃষ্টি করে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। চোর-ডাকাত সন্দেহের নাটক সাজিয়ে যেমন হত্যা করা হচ্ছে, তেমনি সত্যিকারের চোর-ডাকাতকেও গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ আইন নিজের হাতে তুলে নেবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। হত্যার শিকার ব্যক্তি যত নড় অপরাধীই হোক, তাঁকে বিনাবিচারে গণপিটুনি কিংবা অন্য কোন বিবেচনায় হত্যাযোগ্য করার ন্যূনতম সুযোগ নেই। কিন্তু এখন হরহামেশা এসবই ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনা আমাদের সমাজে আগেও ছিল। কিন্তু সেটা পরিকল্পিত কিংবা আইনের শাসনের অভাবে নয়, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ার অংশ ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে যা হচ্ছে সেটা টার্গেট কিলিং, টার্গেটকে বৈধতা দিতে মব জাস্টিস বা উন্মত্ত জনতার বিচার নাম দেয়া হয়েছে। অথচ প্রায় সবগুলো ঘটনার কেইস স্টাডিতে দেখা যায়, কতিপয় সংঘবদ্ধ জনতা বা ছাত্র নামধারীরা একত্রিত হয়ে এই নৈরাজ্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত কিংবা আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের তুলনায় ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রতিটি মব কিলিং কম বেদনার নয়, কম কষ্টের নয়। কোন মৃত্যু দিয়েই আরেকটি মৃত্যুকে লেজিটেমেসি দেয়া যায় না। যার যায়, সে-ই শুধু বোঝে কারও চিরবিদায় কতটা যন্ত্রণার, কতটা যাতনার।
অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব মব কিলিং এর ঘটনায় রাষ্ট্র নির্বিকার, সরকার নিশ্চল এবং বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। আদালতের বাইরের মব জাস্টিসকে খোদ আদালতই বৈধতা দিচ্ছে। অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতারের পরে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ায় প্রেক্ষিতে তাঁকে জামিন দেয়া হয়েছে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম আনোয়ারা বেগমকে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে কতিপয় ছাত্ররা নিজেরাই আটক করে থানায় সোপর্দ করছে এবং আদালত তাঁকে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। এতেই স্পষ্ট হয় যে, খোদ আদালতই এখন মবের তালে চলে এবং আদালতেও চলে মব জাস্টিস। কারণ দেশটা যে এখন ইউনূসের মুল্লুক!