।।আযম খান।।
এই যে ট্যাক্স বাড়ানো হইছে, এমনকি বিদেশ থেকে টাকা বাপ-মায়ের জন্য পাঠাইলেও ট্যাক্স দিতে হবে তাও ১০% এর উপরে। এর নাম ইকোনমিক শক। একেবারে টেক্সটবুক একটা মেথোড। জুলাই-আগষ্ট তো দুনিয়াতে এই প্রথম ঘটে নাই। আগেও গডফাদারেরা নানা দেশে ঘটেছে।
নাওমি ক্লেইনের একটা দূর্দান্ত বই ( The Shock Doctrine) আছে এই ব্যাপারে। কারো আগ্রহ থাকলে পড়ে দেখতে পারেন। আমি সারসংক্ষেপ বলে দেই। এই ইকোনমিক শক থেরাপিগুলো হচ্ছে—
১/ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন। যেমন, বন্দর, এয়ারপোর্ট এসব বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া।
২/ পাবলিক স্পেন্ডিং কমানোর জন্য জনকল্যানমূলক খরচা কমানো। ইতিমধ্যে বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, দরিদ্র ভাতা এসব নানা ভাতায় দেশে হাত দেয়া হইছে।
৩/ জনগনের উপরে ট্যাক্সের বোঝা চাপায়ে দেয়া।
নাওমি ক্লেইন যে শুধু থিওরিগত আলোচনা করেছেন জিনিসটা তা না। এই শক থেরাপি চিলিতে আলেন্দেকে হত্যার পরে ১৯৭৩ সালে প্রয়োগ করা হইছে। সেভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে রাশিয়াতে প্রয়োগ করা হইছে। ইরাকে প্রয়োগ করা হইছে।
নাওমি ক্লেইন এই ইকোনমিক শককে ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম (Disaster Capitalism) হিসাবে দেখাইছেন। এইটার উদ্দেশ্য বিদেশী ব্যাবসায়ী এবং দেশী ছোট একটা গ্রুপকে ধনী থেকে ব্যাপক ধনী বানানো। এবং এই ধনী বানানো হয় সাধারন জনগনের পকেট কেটে এবং তাদের নানাভাবে বঞ্চিত করে।
নোয়ান চমস্কিও তার নানা বইয়ে এই ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। চমস্কির পয়েন্টগুলো এরকম—
১/ যুক্তরাষ্ট্র এমন সরকার পরিবর্তনকে সমর্থন করে যেখানে বিদ্যমান সরকার নবউদারনৈতিক (Neoliberal) সংস্কারের বিরোধিতা করে বা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
২/ সরকার পরিবর্তনের পর, নতুন সরকারগুলোকে আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিচালিত অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, যা বৈশ্বিক পুঁজির স্বার্থে কাজ করে। আমাদের বর্তমান সরকারের ক্যাবিনেটের অনেকেই আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের সুরে সুর মেলান। ট্যাক্স বৃদ্ধি এই সুরের ফলাফল।
৩/ এই নীতিগুলো প্রায়ই দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং নির্ভরশীলতার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানে মানুষ দরিদ্র হলে এবং কাজ না থাকলে আরো স্বস্তায় কাজ করতে আগ্রহী হয়। তখন বিদেশীরা এসে ওখানে কলকারখানা খুলে আর স্বস্তা শ্রমের ফায়দা উঠায়।
চমস্কি দেখিয়েছেন, যেসব সরকার আমেরিকা তথা এসব পশ্চিমা নীতি প্রতিহত করেছে (যেমন চিলির আল্লেন্দে বা হাইতির অ্যারিস্টিড), তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা দুর্বল করা হয়েছে।
মোদ্দাকথা, চমস্কির মতে, শক থেরাপি এবং নবউদারনৈতিক (Neoliberal) সংস্কার একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অংশ, যার লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক সম্পদ ও বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা— যা করা হয় “সংস্কার” বা “আধুনিকায়ন” এর মুখোশে।
আমার বা আপনার বাপ-মা তো টাকা কামায় না। তারা আমাদের উপরে নির্ভরশীল। নির্ভরশীলতা আর আয় দুটো এক জিনিস না। আমরা তো ট্যাক্স যে দেশে থাকি সেখানে একবার দেই। তবে কেন বিদেশীদের খায়েশ পূরনে আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের উপরে কর চাপানো হবে! তাদের জীবনযাত্রার খরচ, চিকিৎসার জন্য আমরা টাকা পাঠাই। আমেরিকা, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের দালালদের পেট মোটা করার জন্য না।