কবির য়াহমদ।।
কূটনৈতিক চ্যানেল বাদ দিয়ে গুপ্ত-এজেন্সি, গুপ্ত-প্লেয়ার দিয়ে সফর পরিকল্পনা, দেশ পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণের খেসারত দিতে হলো মুহাম্মদ ইউনূসকে। কোনরূপ প্রস্তুতি ছাড়াই ব্রিটেনে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েনমেন্ট চাইলেন, এবং প্রত্যাখ্যাত হলেন। আর এদিকে তাঁর প্রেস সচিব জানালেন প্রধানমন্ত্রী কিয়্যার স্টারমার সম্ভবত কানাডায়। অথচ তাঁর দেশে দিব্যি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সামলাচ্ছেন স্টারমার।
প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বুঝতে পারা উচিত ছিল এই সময়ে বিশ্বনেতাদের অবস্থান জানা কারো পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। ইউরোপের নেতারা, এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীও তাঁর এক্স-হ্যান্ডলে অনেক কিছু সেয়ার করে থাকেন, যা তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের প্রচারণার অংশ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
শফিকুল আলম যখন বলছিলেন কিয়্যার স্টারমার দেশে নাই, বিদেশ গেছেন। তখনই সবাই আসলে খুঁজতে নেমেছে স্টারমার কোথায়? এক্স-হ্যান্ডল বলছিল তিনি নিজ দেশেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো শফিকুল আলম নিজেকে যেখানে নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে তাঁর যেকোনো কথা বিশ্বাসের আগে অন্তত পাঁচবার ভাবে। এখানেও তাঁর অসত্য বয়ান প্রকাশিত হয়ে গেছে।
ইউনূসের নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল শফিকুলকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা। তিনি যা করছেন সেটা ইউনূসের ভাবমূর্তির অবশিষ্টাংশও রাখছেন না। এতদিন বিশ্ব ঘুরে ঘুরে যা কামিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস, তাঁর লন্ডন সফর সেখানে বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিয়্যার স্টারমার কেন মুহাম্মদ ইউনূসকে সাক্ষাৎ দিলেন না, এই প্রশ্ন কি জাগছে না? যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কেন পাত্তা দিলেন না ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী? প্রশ্নের উত্তর অপ্রকাশিত হলেও কঠিন নয়।
এটা মূলত লেবার দলের একজন সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এমপির প্রতি বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের আচরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ওই এমপি হচ্ছেন টিউলিপ সিদ্দিক। ড. ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর একপাক্ষিকভাবে বাংলাদেশে টিউলিপের বিরুদ্ধে উড়ো অভিযোগ এনেছেন, এবং সে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই মন্ত্রিত্ব ছাড়েন টিউলিপ। স্বাধীন তদন্ত সংস্থা দীর্ঘ তদন্ত শেষে যদিও টিউলিপকে তাঁর দেশে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে, তবে বাংলাদেশে এই অভিযোগ এখনো রয়ে গেছে। টিউলিপ হচ্ছেন কিয়্যার স্টারমারের দলের এমপি।
এখানে উল্লেখের দরকার, লন্ডন যাচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস সেটা জেনে টিউলিপ সিদ্দিক তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন। সেটা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। প্রথমে শফিকুল আলম চিঠি পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও কিয়্যার স্টারমারের সাক্ষাৎ না পাওয়ার পর এটা স্বীকার করছেন। এই চিঠি দিয়ে টিউলিপ তাঁর দেশে তাঁর ভোটারদের কাছে নিজের সততার প্রমাণ দিতে চেয়েছেন। এটা নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্যেই কেবল নয়, এটা হচ্ছে চিরায়ত ব্রিটিশ রাজনীতি।
এখানে কিয়্যার স্টারমারের সাক্ষাৎ না পাওয়ার প্রাথমিক যে আলোচনা, সেটাতে টিউলিপ প্রকাশ্যে না থাকলেও প্রভাবক হিসেবে রয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূস যদি হাউস অব কমন্সে গিয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে বৈঠকে সম্মত হতেন, তবে কিয়্যার স্টারমারের সাক্ষাৎ পেতে তাঁর কোন অসুবিধাই হতো না।
ব্রিটেনে টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের বিচার নিয়ে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়েছিলেন। বিতর্কের মুখে তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্বও ছেড়েছিলেন। এরপর লরি ম্যাগনাসের তদন্ত শেষে তিনি সেখান অভিযোগ থেকে মুক্তিও পেয়েছেন। তাই সে দেশে তিনি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও মানহানির অভিযোগ মামলাও করতে পারতেন, কিন্তু সে পথে যাননি। নিজেকে আরও স্বচ্ছ প্রমাণে মুখোমুখি বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। টিউলিপ তাঁর দেশে বুঝাতে চাইছেন তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নয়, বরং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভুল বুঝাবুঝির অবসান চান। ফলে আদালতের শরণ নিচ্ছেন না।
এখানে আদালত প্রসঙ্গে কেন আসলাম— সে প্রসঙ্গে বলি এবার। মনে কি আছে আপনাদের যুক্তরাজ্যে গিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখে পড়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান হাবিব মনসুর ও উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত বছরের অক্টোবরে ওয়াশিংটন ডিসি সার্কিট কোর্ট উপদেষ্টা ও গভর্নরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল, তখন তারা যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। ওই সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা অনেকটাই গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। পরে অবশ্য সে পরোয়ানা স্থগিত হয়েছিল। সে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি মূলত উপদেষ্টা ও গভর্নর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার পর ২৫ বছরের পুরনো একটা বিষয়ে আদালতের রায় এসে পড়েছিল। এবার মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। এখানে তাই উঁকি মারল আটকে ফেলার কৌশল। যদিও ব্রিটেনের রাজনীতি অন্য ধাঁচের; প্রতিহিংসার চাইতে তাঁরা বরং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে।
এখন পর্যন্ত কিয়্যার স্টারমারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাননি মুহাম্মদ ইউনূস, তবে এটা যে চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে এমন না। এটা মূলত বরফ গলানোর কৌশল। এদিকে গললে, ওদিকেও প্রভাব পড়বে। বিষয়টা রাষ্ট্রীয় নয়, ব্যক্তিগত। এখানে তাই রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রশ্ন নেই। তবে আফসোস হচ্ছে, মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগত সফরে হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন সরকারপ্রধান। তাই কোনো না কোনোভাবে এই অপমানটা দেশেরও অপমান হয়ে যায়। এখানে ব্যক্তির সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ।
অনেককেই বলতে শুনবেন রাজা তৃতীয় চার্লসের সাক্ষাৎ যখন পাচ্ছেন মুহাম্মদ ইউনূস, তখন কী দরকার প্রধানমন্ত্রী কিয়্যার স্টারমারের সঙ্গে সাক্ষাতের, কী দরকার বৈঠকের। অথচ যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানি দেশটির সর্বোচ্চ ব্যক্তি হলেও সরকারপ্রধান নন। তাঁর নামে সবকিছু পরিচালিত হলেও তিনি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক নন।
ব্রিটেনকে বলা হয় মাদার অব মডার্ন ডেমোক্র্যাসি বা আধুনিক গণতন্ত্রের জননী। তবু ওখানে রাজা বা রানি থাকেন। এই রাজা বা রানির স্ট্যাটাস হচ্ছে অনেকটাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মতো। তবে পার্থক্যের জায়গা হচ্ছে রাজা বা রানি কেবল ব্রিটেনেরই শীর্ষ ব্যক্তি নন, তিনি আরও অনেকগুলো দেশেরও রাজার পদ অলঙ্কৃত করে থাকেন। শুনতে কেমন লাগলেও দেশ ভেদে এটাই সত্য। বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যক্তি যেখানে রাষ্ট্রপতি, ব্রিটেনে সেখানে রাজা বা রানি। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে নিয়মরক্ষায় যেখানে রাষ্ট্রপতিকে সবকিছু অবহিত করতে হয়, ব্রিটেনেও তেমনি। ওখানে যেমন সংসদই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, বাংলাদেশেও তেমন। তবে ব্রিটেনের গণতন্ত্র আর আমাদের গণতন্ত্রের অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এখানে যেমন রাষ্ট্রপতিকে যা ইচ্ছা তাই বলা হচ্ছে, ওখানে শিষ্টাচারের খাতিরে হলেও সে সব অসম্ভব। এখানে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতিকে অগ্রাহ্য করছেন, কিন্তু অন্য কোথাও এসব সম্ভব না। আমাদের এখানে অভব্যতা আর শিষ্টাচারকে বৃদ্ধাঙুলি দেখালেও সেটা অনেকের কাছে সাহসিক কীর্তি, কিন্তু সভ্য দেশে ওসব অনৈতিকতা অচিন্তনীয়।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরে আমাদের প্রাপ্তির কিছু নাই। এটা তাঁর আরও একটা বিদেশ ভ্রমণের ফিরিস্তি। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের দলিল। একই সঙ্গে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পাওয়া লজ্জারও। নোবেল-জয় মানে বিশ্বজয় নয়, সম্ভবত এই প্রথম বুঝতে পারছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ব্রিটেনে অপমানিত বাংলাদেশ। এই অপমানের দায় দেশবাসীর নয়। দায় যখন দেশবাসীর নয়; তখন এটা আপনারই থাক, প্রফেসর!