জাহিদুর রহমান
দেশে ফলের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত দুই দশক ধরেই ফল উৎপাদনে টেকসই ও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। ছোট দেশ, জমি কম। তবুও বিশ্বের শীর্ষ ১০ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। একসময় মানুষ বাড়ির আশপাশের ছোট বাগানে সীমিত পরিমাণ ফল উৎপাদন করত। এখন দেশের প্রায় সব অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফলের চাষ ছড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ১৮ বছরে ফল উৎপাদন গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ করে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের মানুষের ফল বেশি খাওয়ারও তথ্য দিচ্ছে। বিবিএসের খানা জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খেয়েছেন। ২০১০ সালে এই গড় ছিল ৪৪ দশমিক ৭ গ্রাম। এর মধ্যে ২০১৬ সালে অবশ্য ফল খাওয়া কমে গিয়েছিল, জনপ্রতি গড়ে ৩৫ দশমিক ৮ গ্রাম।
একসময় দেশে কাঁঠাল ও আম ছিল প্রধান ফল। এখন অন্তত ২২ প্রজাতির ফল বাংলাদেশের মানুষ নিয়মিত খাচ্ছে। বার্ষিক কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। আম উৎপাদনে সপ্তম। পেয়ারা উৎপাদনেও সপ্তম। এখন জাম, বরই, কামরাঙা, কতবেল, লেবু, আনারস, লটকন, আতা, সফেদার মতো স্থানীয় ফলের পাশাপাশি স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, মাল্টা, রামবুটান ইত্যাদি বিদেশি ফলের চাষ ব্যাপক হারে বেড়েছে।
এক দশক আগে দেশে প্রায় ৫৬ ধরনের ফল চাষ হতো। এখন ৭২ ধরনের ফল চাষ হচ্ছে। ফল চাষে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি নতুন বাজারও তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাড়ছে। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ ৩৮টি দেশে বাংলাদেশের আম, লিচু, পেয়ারার চাহিদা রয়েছে।
আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম, জনসংখ্যায় অষ্টম বাংলাদেশ। সবচেয়ে কম জমি আর বেশি মানুষের এই দেশে বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষ বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা
দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চার-পাঁচ বছর নতুন ফল ড্রাগন ও অ্যাভোকাডো এবং দেশি ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, খরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর উৎপাদনও বেড়েছে।
বছর পাঁচেক আগেও ড্রাগন ছিল বড় সুপারশপের ফল। দাম বেশি থাকায় কেবল অবস্থাপন্ন ক্রেতারা কিনতেন বিদেশ থেকে আসা এ ফল। এখন ফুটপাতের দোকান কিংবা ভাসমান ভ্যানেও শোভা পাচ্ছে ড্রাগন। খুচরা বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি ড্রাগন ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. সাত্তার মণ্ডল বলেন, দেশে আশাব্যঞ্জক হারে বিদেশি ফল উৎপাদন হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আমদানিনির্ভরতাও কমছে। এ খাতে উৎপাদন বাড়াতে এবং উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে কিছু নীতি-সহায়তা দিতে হবে সরকারকে। এটি আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, মূলধন জোগানসহ বিভিন্নভাবে হতে পারে। তিনি বলেন, এখনও ফল সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও প্যাকেজিং ব্যবস্থা আধুনিক হয়নি। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
একসময় বেশির ভাগ স্থানীয় ফল গ্রীষ্মের তিন মাস পাওয়া যেত। মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করত মে, জুন ও জুলাই মাসের জন্য। এ সময় আম, লিচু, কাঁঠাল ও অন্যান্য ফল বাজারে আসে। দৃশ্যপট এখন পাল্টেছে। অনেক ফল এখন সারা বছর উৎপাদন হয়, পাওয়া যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারাসহ অনেক ফলের নতুন জাত এসেছে। কিছু জাত আগাম এবং দেরিতে ফলন দেয়। ফলে সারা বছর ফলের সরবরাহ থাকে।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করিম সমকালকে বলেন, দেশি ফলের উৎপাদন বেশ ভালো। অনেক বিদেশি ফলও এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন ভালো হওয়ায় মৌসুমি ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে এবং দামও স্থিতিশীল থাকে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফলের আমদানি খরচ বেড়েছে। আগে ২০ কেজি আপেলের প্যাকেটে শুল্ক দিতে হতো ৩০০ টাকা। এখন সেটা ১ হাজার ৪০০ টাকা। এক কেজি আঙুরে দিতে হতো ৩০ টাকা, এখন ১০০ টাকা। আবার ডলারের দাম বেশি। আবার বিদেশি ফল সবুজ মাল্টা, ড্রাগন এগুলো দেশে উৎপাদন হচ্ছে। তাই বিদেশি ফলে ওপর নির্ভরতা কমছে, আমদানিও কমছে।
ফল উৎপাদনে ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংরক্ষণ একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, সরকারের পার্টনার প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী আধুনিক কোল্ডস্টোরেজ স্থাপনের কাজ চলছে। দীর্ঘমেয়াদি ফল সংরক্ষণের জন্য নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণায় সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। কাঁঠাল, আম ও আনারস শুকিয়ে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, যাতে সারা বছর ফল পাওয়া যায় এবং খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে।