আজ ২৫ জুন ২০২৫, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তৃতীয় বার্ষিকী। ২০২২ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বপ্নের এই সেতু জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ স্থাপনকারী এই ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু শুধু একটি অবকাঠামোই নয়, বাংলাদেশের সংকল্প, সাহস এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অর্থনৈতিক বাধা, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে পদ্মা সেতু সফলভাবে নির্মিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু নির্মাণের পেছনের চ্যালেঞ্জগুলোর বিশ্লেষণ করা হলো।
আন্তর্জাতিক বাধা ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল
পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, এবং প্রাথমিকভাবে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) এই প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশ্বব্যাংক প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা দিলেও ২০১২ সালে তারা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করে। এই অভিযোগে কানাডার একটি আদালতে মামলা দায়, যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সামনে আসে। যদিও পরবর্তীতে আদালত বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয় এবং দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, ততক্ষণে প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
বিশ্ব ব্যাংকের এই পদক্ষেপকে অনেকে বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করেন। তিনি ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। এই সিদ্ধান্ত শুধু দেশের আত্মমর্যাদাকে উঁচু করেনি, বরং বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু: একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ বাতিলের পর সরকার বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ৩০,১৮৮ কোটি টাকা (প্রায় ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপ, কারণ বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এত বড় প্রকল্পে নিজস্ব তহবিল ব্যয় করা ছিল বিরাট ঝুঁকি। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার জনগণের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যায়।
সরকার বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ, বন্ড ইস্যু এবং বিভিন্ন সরকারি তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। জনগণের মধ্যেও পদ্মা সেতুর প্রতি গভীর আবেগ জাগে। অনেকে এই প্রকল্পকে ‘জনগণের সেতু’ হিসেবে দেখেন, যা বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এই আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের কৌশল এবং জনগণের সমর্থন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ
পদ্মা নদী তার অস্থির প্রবাহ, গভীরতা এবং শক্তিশালী স্রোতের জন্য কুখ্যাত। এই নদীর উপর সেতু নির্মাণ ছিল প্রকৌশলের দিক থেকে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। পদ্মার তলদেশে পলির স্তর এবং নদীর গতিপথের পরিবর্তন নির্মাণ কাজকে আরও জটিল করে তুলেছিল। সেতুর পাইল ফাউন্ডেশন স্থাপনের জন্য প্রায় ১২০ মিটার গভীরে যেতে হয়েছিল, যা বিশ্বের অন্যতম গভীর ফাউন্ডেশন।
চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এমবিইসি) এই প্রকল্পের প্রধান ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় সময়সীমা বাড়ে। তবুও, উন্নত প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের দক্ষতায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হয়। সেতুর ডিজাইনে রেলপথ এবং সড়কপথ একসঙ্গে রাখা হয়েছে, যা এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক সেতুতে পরিণত করেছে।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক চাপ
পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় বাংলাদেশকে শুধু আর্থিক ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি, বরং আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপও সামলাতে হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের পেছনে কিছু আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রকল্পকে সমালোচনা করে এবং এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
কানাডার আদালতে দুর্নীতির মামলা এবং বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা ছিল। তবে শেখ হাসিনার সরকার এই সব অভিযোগের বিরুদ্ধে স্বচ্ছভাবে লড়াই করে এবং প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে। এই প্রকল্পের সাফল্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর প্রভাব ও তাৎপর্য
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি যোগ করেছে, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বব্যাংকের মতে, এই সেতু বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১.২ থেকে ১.৭ শতাংশ অবদান রাখছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ফলে বাণিজ্য, কৃষি, পর্যটন এবং শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে রপ্তানি আয় ৯৫৪ কোটি টাকারও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় ১৫.৭৮% বৃদ্ধির হার নির্দেশ করে। এছাড়া, নির্মাণ খাতে ২৯%, কৃষি খাতে ৯.৫% এবং উৎপাদন ও পরিবহন খাতে ৮% প্রবৃদ্ধি পদ্মা সেতুর প্রভাবে সম্ভব হয়েছে। এই সেতু দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে বছরে ০.৮৪% অবদান রাখছে।
জাতীয় রাজস্ব আয়ে পদ্মা সেতুর অবদান
পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায়ের মাধ্যমে আয়ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উদ্বোধনের পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই সেতু থেকে প্রায় ১,৬৪৮ কোটি টাকার বেশি টোল আদায় হয়েছে, যা দুই বছরে ১ কোটি ২৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপারের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৯,১৬৮টি যানবাহন সেতু পারাপার করে, যা থেকে দৈনিক গড়ে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার টোল আদায় হচ্ছে। প্রথম বছরে টোল আয় ছিল ৮০১ কোটি টাকা, এবং দ্বিতীয় বছরে তা বেড়ে ৮৪৭ কোটি টাকা হয়েছে। এই আয় সেতুর নির্মাণ ব্যয় (প্রায় ৩০,১৯৩ কোটি টাকা) পুনরুদ্ধার এবং রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, টোল আয়ের বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে নির্মাণ ব্যয় নির্ধারিত সময়ের আগেই উঠে আসবে।
পদ্মা সেতুর খরচ ও দুর্ণিতি সংক্রান্ত গুজব
পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক গুজব ছড়ালেও, এই অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই বিশ্বব্যাংক এবং কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়নি। তবে, সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত পরিবেশ রক্ষা এবং স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসনের মতো অতিরিক্ত খরচের বিষয়গুলো অনেকাংশে জনগণের অগোচরে থেকে গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যার মধ্যে নদীর তীরবর্তী এলাকার ক্ষয়রোধ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ, এবং নির্মাণকালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এছাড়া, সেতুর আশপাশের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের প্রায় ১৪,০০০ পরিবারকে স্থানান্তর করতে হয়, যার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই খরচের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নতুন বসতি নির্মাণ, ক্ষতিপূরণ এবং জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যাদের জমি কিংবা আবাসস্থলে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এই মেগা প্রকল্প তাদের জন্য সেতুর জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে ৭টি পুর্নবাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে ৩০১১টি পরিবারের মাঝে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আড়াই, পাঁচ ও সাড়ে সাত শতাংশ জমি। বসবাসকারী পরিবারগুলোর সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণে বিশাল খেলার মাঠসহ শিক্ষার সব ধরনের সুবিধাসম্বলিত ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পাঁচটি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র চলমান রয়েছে। প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে দ্বিতল পদ্মা সেতু পুনর্বাসন জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের সুযোগও আছে। দৈনন্দিন কেনাকাটা ও ব্যবসা পরিচালনা এবং কর্মসংস্থানের জন্য বিশাল মার্কেট শেডও নির্মাণ করা হয়েছে।
এসব খরচ প্রকল্পের মোট বাজেটের (৩০,১৯৩ কোটি টাকা) একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও, জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে তথ্যের অভাব এবং দুর্নীতির গুজব এই প্রচেষ্টাগুলোকে প্রায়শই ছায়ায় ফেলে দেয়।
পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ সড়কের উন্নয়ন
পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর সংযোগ সড়ক, ব্রিজ এবং কালভার্ট নির্মাণ, যা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ নিশ্চিত করেছে। এই সংযোগ সড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১২.১১৭ কিলোমিটার, যার মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ১০.৫০ কিলোমিটার এবং মাওয়া প্রান্তে বাকি অংশ রয়েছে। এই সড়কে ৪ লেনের ডুয়েল ক্যারেজওয়ে, ২৭.৬ মিটার প্রস্থের রাস্তা, ৫টি ব্রিজ, ২০টি বক্স কালভার্ট, ৮টি আন্ডারপাস, ১২ কিলোমিটার সার্ভিস রোড এবং ৩ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক নির্মিত হয়েছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা ক্রসিং এলাকায় ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, যার দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার, পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে, যা ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই অংশে টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, সার্ভিস এরিয়া, ওয়ে স্টেশন এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া এলাকাও অন্তর্ভুক্ত। সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড কাজ করেছে, এবং এই খাতে মোট প্রকল্প ব্যয়ের (৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা) একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়েছে, যা প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক বাধা, দুর্নীতির অভিযোগ, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং জনগণের সমর্থনে এই সেতু সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়, বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সংকল্পের প্রতিফলন। তৃতীয় বার্ষিকীতে এই সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আলো ছড়াচ্ছে।