গত বছরের ৫ই আগস্ট সেনাবাহিনী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। যার ফলে জুলাই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টরা তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানায়। জনগণ সেসময় তাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না পেলেও ক্রমশ সেই সেনাবাহিনী বছর না ঘুরতেই জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বব্যাপী সম্মানিত এই বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে মব সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সারাদেশে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সেনাবাহিনীর আচরণ এবং ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহে এক কলেজ অধ্যক্ষের গ্রেপ্তার, ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ উদ্ধার, নকলায় বিএনপি কর্মীদের দ্বারা কিশোর বয়সী ছাত্রলীগ কর্মী শাকিলের পা কুপিয়ে বিচ্ছিন্নের মর্মান্তিক ঘটনা এবং সাবেক সিইসি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হুদাকে মব সন্ত্রাসীদের জুতার মালা পরানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
ময়মনসিংহে অধ্যক্ষের গ্রেপ্তার: রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ
ময়মনসিংহে এক কলেজ অধ্যক্ষকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তিনি বলেছেন, “আওয়ামী লীগ করায় দোষ হলে যেকোনো শাস্তি মেনে নেব।” এই ঘটনা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রমের মধ্যে ঘটেছে। উক্ত ঘটনার নেতৃত্ব দেন ময়মনসিংহ সদর ক্যাম্প কমান্ডার, ১৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের মেজর জায়েদ সাদ আল রাব্বী। সেনাবাহিনী জনতার জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললেও এই ধরনের গ্রেপ্তারে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের অভিযোগ উঠেছে।
সরকারী প্রজ্ঞাপনে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের নিষধাজ্ঞা থাকলেও প্রশ্ন উঠেছে, উক্ত অধ্যক্ষ প্রকাশ্যে কোন জনসংযোগ, প্রচারণা, মিছিল বা প্রতিবাদ সমাবেশ কিছুতেই জড়িত ছিলেন না। উক্ত সেনা কর্মকর্তা অধ্যক্ষের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে আওয়ামী লীগ সংক্রান্ত সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, মোবাইল ফোন তল্লাশি করে আওয়ামী লীগ ধরা কি সেনাবাহিনীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? আগস্ট পরবর্তী সময়ে এভাবে আওয়ামী লীগ সন্দেহে ধরে ধরে মোবাইল ফোন তল্লাশি করতে দেখা গেছে উগ্রবাদীদের। সেই দায়িত্ব কি এখন সেনাবাহিনী পালন করছে?
সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা এ ধরনের মব সন্ত্রাসের ঘটনাকে উৎসাহিত করছে, যা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে।
ময়মনসিংহে ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ উদ্ধার
ময়মনসিংহের শান্তিনগর মোড়ে গত ১৬ই জুন আকাশ নামের ছাত্রলীগের এক নেতার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ দাবি করেছে, মরদেহের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে। যদিও আকাশের স্বজনরা ছবি ও ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে দেখিয়েছেন, তার শরীরর বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত, হাতের কয়েকটি জায়গায়, মুখমন্ডলে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিতই ঘটেছে, যখন সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছে, তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের ক্ষোভ, সেনাবাহিনী এই ধরনের হত্যাকাণ্ড রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এসব ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নকলায় শাকিলের কুপিয়ে হত্যা
শেরপুরের নকলায় ভ্যানচালকের পুত্র ১৬ বছর বয়সী কিশোর ছাত্রলীগ কর্মী শাকিলকে কুপিয়ে পা বিচ্ছিন্ন করেছে স্থানীয় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। জড়িতদের নাম-ঠিকানা ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। অথচ অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেনাবাহিনী মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের আশ্বাস দিলেও এই ঘটনায় তারা কোনো তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়নি। বরং শাকিলের পিতা জানিয়েছেন, তিনি সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনী জান-মালের কতটা নিরাপত্তা দিতে সক্ষম, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে জনমনে।
সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলা
গত ২২শে জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম নূরুল হুদাকে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাসা থেকে মারতে মারতে বের করে এনে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই। ব্যাপক মারধরের পর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাকে ডিম ছুড়ে মারা, জুতাপেটা করা, জুতার মালা গলায় দিয়ে অপদস্থ করার মত ঘটনায় ধিক্কার জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানবিক মানুষজন।
এই ঘটনার সমালোচনা করতে গিয়ে মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী এই ঘটনায় কোনো প্রতিরোধমূলক বা নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা পালন করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছিল মব সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ সেনাবাহিনীর নীরবতা তাদের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা ও সমালোচনা
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ৫ই আগস্ট ২০২৪-এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জনমানুষের জানমালের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বারবার জানিয়েছেন, “জনগণের জানমালের নিরাপত্তা আমার দায়িত্ব।” অথচ মব সন্ত্রাসের ঘটনা বন্ধ হয়নি। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থাকা সময়ে ২০০-র বেশি মানুষ মব সন্ত্রাসে নিহত হয়েছে, এবং শতাধিক রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সারাদেশের মানুষ দেখে।
এর আগেও দেখা গেছে, ৫ই আগস্ট গণভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে পদদলিত করছে সেনাসদস্য, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি (জাদুঘর) ভেঙে ফেলার সময় সেনাসদস্যদের নীরবে দাঁড়িয়ে উৎসাহ যোগানো, ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যেতে যেতে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন করার মত অসংখ্য ঘটনা সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এছাড়াও দেশজুড়ে নারী ও শিশু ধর্ষণ, রাজনৈতিক কার্যালয় ও রাজনৈতিক কর্মীদের ঘরবাড়ি ভেঙে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতা ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। কোথাও দেখা যায়নি এসব ঘটনায় মব সন্ত্রাসীদের আটক করা হয়েছে। একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, সেনাবাহিনীর কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকি সেনা হেফাজতে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে ইতিমধ্যে।
সেনাবাহিনীর সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে, কারণ তারা মাদক উদ্ধার এবং বস্তিতে অভিযানে যতটা ব্যস্ত, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ততটাই ব্যর্থ। উদাহরণস্বরূপ, ময়মনসিংহের নান্দাইলে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে, কিন্তু মব সন্ত্রাস বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনাগুলোতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে বলা হয়েছে, “সেনাবাহিনী মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও, বাস্তবে তা উল্টো মহামারির আকার ধারণ করেছে।”
জনগণের আস্থা হারানোর কারণ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির কয়েকজন ‘ক্লিন ইমেজের’ নেতাকে অস্ত্র-মাদকসহ গ্রেপ্তারের ঘটনায় একে ‘সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছে বিএনপি।
এসব ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটনা মব সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোতে সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। অনেক ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগ তাদের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার ভুক্তভোগীরা সেনা ক্যাম্পে ফোন করেও সাড়া পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে। মব সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে, তারা এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ফলে যে সেনাবাহিনী একসময় জনগণের ভালোবাসা ও সম্মানের প্রতীক ছিল, তা এখন ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তার হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হলে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ময়মনসিংহে অধ্যক্ষের গ্রেপ্তার, ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, কুপিয়ে পা বিচ্ছিন্ন করা এবং সাবেক সিইসিকে হেনস্তার মতো ঘটনাগুলোতে সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা জনগণের আস্থা ভাঙার জন্য দায়ী। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সম্মান ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।