।।মাসুদ আলম।।
আপনি তাঁর নামের পাশে কী বিশেষণ বসাবেন? অনন্য? অসাধারণ? হয়তো কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়। কারণ, তাঁর খেলা শব্দের সীমা ছুঁয়ে গেছে। কোনো ভাষায় বোঝানো অসম্ভব ঋতুপর্ণা চাকমার বাঁ পায়ের জাদু। এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর গোল দুটি সবাইকে চমকে দিয়েছে। গোল তো নয়, যেন বিস্ময়।
২১ বছরের এক তরুণীর ভেতর লুকিয়ে থাকা অসীম সম্ভাবনার আগুনও তাতে বেরিয়ে এসেছে নতুনভাবে। বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমার র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে।
এই দলকে হারিয়ে যখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল এক নতুন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি, সেই পথে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার নাম ঋতুপর্ণা।
মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-১ গোলে জয়ে ২টি গোলই ছিল তাঁর। দুটিই বাঁ পায়ের।
২০২২ ও ২০২৪—বাংলাদেশের দুটি সাফজয়ী দলেরই গর্বিত সদস্য ঋতুপর্ণা। প্রথমবার আলো ছিল সাবিনা খাতুনের ওপর।
ঠিক দুই বছর পর কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ যখন সাফ শিরোপা ধরে রাখে, তখন সেই আলোর কেন্দ্রে ঋতু। সাফের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি যেন তাঁর বাঁ পায়ের শিল্পকেই স্বীকৃতি দিয়েছে নেপালের রাজধানীতে।
কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে গত সাফের ফাইনালে তাঁর জয়সূচক গোল ২০ হাজার দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। গোল উদ্যাপনেও ছিল সেই জবাব।
দর্শকদের চুপ করানোর ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ঋতুপর্ণা এসেছেন আপন আলোয় আলো ছড়াতে। অনেকটা একই রকম গোল করে মিয়ানমারের বিপক্ষেও তিনি নিস্তব্ধতায় ডুবিয়ে দেন গ্যালারিকে।
বাঁ প্রান্তে খেলা ঋতুর গতি দুর্দান্ত, বল নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা অবাক করে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে ভালো তাঁর শুটিং।
বাঁ পায়ের এমন নিখুঁত শট বাংলাদেশের নারী ফুটবলে আর কারও পায়ে দেখা যায় কমই। তাঁর গোলগুলো দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটাই বাক্য, ‘ঋতু, ইউ বিউটি।’
কেউ কেউ তো বলেই ফেলেন, ‘এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেট ঋতুপর্ণা চাকমা।’ ভুটানে লিগ খেলছিলেন ঋতু। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে এসে প্রথমে জর্ডান সফরে যান দলের সঙ্গে। এবার মিয়ানমার সফরে দলকে ইতিহাসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন পাহাড়ি কন্যা।
বাংলাদেশ এবারই প্রথম নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে যাচ্ছে, বলাই যায়। এক যুগান্তকারী সাফল্যের হাতছানি সামনে, আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্ম হয়েছে ঋতুপর্ণার বাঁ পায়ের জাদুতে দুটি অনবদ্য গোলের কল্যাণে। শৈশব-কৈশোরে দারিদ্র্য ঋতুকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাবা বরজ বাঁশি চাকমা কৃষক ছিলেন, পরে ক্যানসারে মারা যান। পরিবারে তখন নেমে আসে দুঃসহ সংকট। কিন্তু মেয়েটি থামেনি। রাঙামাটির ছোট গ্রাম মগাছড়ির মাঠে ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে পায়ের নখ উঠে গিয়েছিল ঋতুর।
বীরসেন চাকমা নামের এক স্কুলশিক্ষকের সহায়তায় এগিয়ে যেতে থাকেন। তৃতীয় শ্রেণির সেই মেয়ে একদিন হয়ে উঠবেন দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের রত্ন, কে জানত!
এই ঋতুপর্ণা আজ শুধু একজন ফুটবলার নন, বাংলাদেশের মেয়েদের লড়াই-সংগ্রামের এক প্রতীকও। তিনি গোল করেন; কারণ, জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, হার মানা চলবে না।
১০ বছর আগে পিতৃহারা মেয়েটি নানা বাধা পেরিয়ে চলতে চলতে শিখেছেন, বাঁ পায়ের একটি নিখুঁত শট দিয়েই ইতিহাস লেখা যায়। ঋতুপর্ণা তা লিখে চলেছেন প্রতিদিন।
সামনে এশিয়ান কাপ, সেখানে ভালো করলে মিলবে বিশ্বকাপের টিকিটও।
বয়স তো মাত্র ২১! রাঙামাটির রাঙা মেয়ে ঋতুপর্ণার রঙে একদিন রঙিন হবে বিশ্বকাপের মঞ্চ, এই স্বপ্ন দেখার সাহস তো বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা করতেই পারে!