ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২৫ — রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার রজনী বোস লেনে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৪২)। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি ওই এলাকায় লাল তার ও সাদা তারের ব্যবসা করে আসছিলেন। একইসাথে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় হলেও তিনি বর্তমানে কেরানীগঞ্জে বসবাস করতেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত কিছুদিন ধরে মঈন, টিটু এবং অপুদাস নামের তিনজন সোহাগের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে চকবাজার থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল হক রনি ওরফে ভাইয়া রনি, রজ্জব আলী পিন্টু এবং চঞ্চল হোসেনের নাম। তারা সবাই যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা এবং ছাত্রদল নেতা ইসহাক সরকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চঞ্চলের বাসার নিচতলায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেট সংলগ্ন এলাকায় মঈনের ব্যক্তিগত অফিস ছিল, যা দীর্ঘদিন ধরেই অপরাধ কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
৮ জুলাই বিকেলে মঈন, টিটু ও অপুদাস সহ ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৪ নম্বর রজনী বোস লেনে গিয়ে তাকে খুঁজে বেড়ায়। তারা সোহাগের গোডাউনে তালা ঝুলিয়ে দেয় এবং হুমকি দিয়ে বলে, “এই এলাকার তারের ব্যবসা এখন থেকে শুধু আমাদের।” বিদায় নেওয়ার সময় টিটু পিস্তল থেকে চার-পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করে এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে।
পরদিন ৯ জুলাই বিকেলে সোহাগ তার দোকানে এলে, মঈন, টিটু ও অপুদাসসহ প্রায় ৭০-৮০ জন সন্ত্রাসী তাকে জোরপূর্বক টেনে হিঁচড়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটে নিয়ে যায়। সেখানে সোহাগের উপর লোহার খুঁটি এবং পাথর দিয়ে একের পর এক আঘাত চালানো হয়। তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়, এবং মাথায় আঘাত করার নির্দেশ দিতে থাকে মঈন নিজে। পুরো ঘটনাটি আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরা ও জনতার মোবাইলে ধারণ হয়। সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও তার দুই পা তুলে রাস্তায় নিয়ে আসা হয়, যেখানে মঈন ও টিটুকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা যায়। অপুদাস নিহতের শরীরের উপর উঠে নৃত্য করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন প্রধান ব্যক্তি মঈন, টিটু এবং অপুদাসের রাজনৈতিক পরিচয় অত্যন্ত স্পষ্ট। মঈন ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং চকবাজার থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। ঘটনার দিন তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী। টিটু ৩১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, যদিও বর্তমানে কোনো পদ নেই, তবে অতীতে তিনি চকবাজার থানা যুবদলের আহ্বায়ক এবং দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবা করীম লাকি ও সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তার বড় ভাই ছিলেন কুখ্যাত যুবলীগ ক্যাডার পাগল আহমেদ, যিনি নয়াবাজার এলাকায় ১৫ বছর আগে খুন হন। অপুদাস বর্তমানে চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ইসহাক সরকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তিনি মিটফোর্ড এলাকায় চঞ্চলের আশ্রয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করেন।
এ ঘটনার পর এলাকাবাসী হতবাক হয়ে গেছে। তারা বলছে, গত ১০-১৫ বছরে এভাবে প্রকাশ্যে, দিনের আলোয় এমন ভয়ংকর ও পৈশাচিক কায়দায় কাউকে খুন হতে দেখা যায়নি। নিহতের পরিবার এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী সমাজ দ্রুত বিচার ও সন্ত্রাসীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এলাকাবাসী বলছে, এখন শুধু দ্রুত বিচার নয়, পুরো এলাকাটিতে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।