রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সম্মুখে ভাঙারি ব্যবসায়ী চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হইয়াছেন। তাহাকে একদল দুর্বৃত্ত সিমেন্টের কংক্রিট, পাথর, রড ইত্যাদি দিয়া এলোপাতাড়ি আঘাত করিয়া ও দা দিয়া কোপাইয়া হত্যা করে। এক পর্যায়ে তাহাকে বিবস্ত্র করা হয় এবং তাহার লাশের উপর লম্ফঝম্ফ করা হয়। সেই বর্বরতম ঘটনার একটি ভিডিও গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হইলে ঘটনাটির কথা জানিতে পারিয়া আমরা নিস্তব্ধ হইয়া যাই। সমগ্র দেশে উঠে প্রতিবাদের ঝড়। বিস্ময়কর ব্যাপার হইল, তাহাকে লোকজনের সম্মুখে নৃশংসভাবে হত্যা ও হত্যার পর টানাহ্যাঁচড়া করা হইলেও অনেকে তাহা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছেন। তাহাকে রক্ষায় আগাইয়া আসেন নাই। ইহাতে বুঝা যায়, কী ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আমরা বসবাস করিতেছি! সমাজে ভয়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতি বিরাজমান থাকায় অন্যায়-অপকর্ম প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, মানুষ অনেক সময় সাহস করিয়া কিছু বলিতেও পারে না। ইহা হইতে আমরা কবে পরিত্রাণ লাভ করিব?
দেশে ইদানীং পৈশাচিক খুনখারাবি বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। একই দিন খুলনায় নিজের বাড়ির সম্মুখে এক রাজনৈতিক নেতাকে গুলি করিয়া ও পায়ের রগ কাটিয়া হত্যা করা হইয়াছে। চাঁদপুরে মসজিদের খতিবকে কোপাইয়া হত্যার চেষ্টা হইয়াছে। তাহার পূর্বে চট্টগ্রাম নগরের রৌফাবাদ এলাকায় স্ত্রীকে কোপাইয়া হত্যার পর লাশের ১১ টুকরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়াইয়া দিয়াছে এক পাষণ্ড স্বামী। এই সকল ঘটনা আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানায়! এই সকল হত্যাকাণ্ড দেখিয়া আমরা বাকরুদ্ধ হইয়া পড়িতেছি। মনে হইতেছে আমরা যেন এক নরকে বসবাস করিতেছি! এক পরিসংখ্যান হইতে জানা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর হইতে গত জুন পর্যন্ত ২৫৩টি নৃশংস ঘটনায় নিহত হইয়াছেন ১৫৩ জন। আহত হইয়াছেন ৩১২ জন। অনেকে মব সন্ত্রাসের শিকার হইয়াছেন। বিশ্লেষকরা বলিতেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারহীনতা ও আইনের শাসনের অভাবে সাধারণ মানুষ নিজেরাও অনেক সময় আইন হাতে তুলিয়া লইতেছে।
উল্লেখ্য, শুধু শহর-নগর নহে, আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও অনুরূপ নানা নৃশংস ঘটনা ঘটিতেছে। শিক্ষাদীক্ষার প্রসার, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, আর্থসামাজিক উন্নতি ইত্যাদি সত্ত্বেও আমরা ক্রমেই মানবতা-সভ্যতা যেন হারাইয়া ফেলিতেছি। সমগ্র বিশ্বে যেমন নানা অস্থিরতা ও অরাজকতা বিরাজ করিতেছে, তেমনি বাংলাদেশও তাহার বাহিরে নহে। আধুনিককালে আমাদের সমাজে দ্রুত সামাজিক রূপান্তর ঘটিয়াছে; কিন্তু কোথায় মানবিকতা, সহনশীলতা ও স্থিতিশীলতা? প্রশ্ন হইল ইহা কীসের আলামত? বিশেষ করিয়া, কোন পরিস্থিতিতে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলিয়া লয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ মনে করে-থানা বা কোর্ট-কাচারিতে গিয়া মামলা করিয়া কী লাভ? মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা ও বহু খরচাপাতির কারণে ধৈর্য ধারণ করা কি কঠিন কাজ নহে? ইহাতে অনেকে শেষ পর্যন্ত ফতুর বা নিঃস্ব হইয়া পড়েন। ভিটেমাটি, ঘটিবাটি পর্যন্ত বিক্রয় করিয়া দেন। এই জন্য মানুষ যখন চাঁদাবাজ-মাস্তান ও দুর্বৃত্তদের নিকট জিম্মি ও অসহায় হইয়া পড়ে, তখন নৃশংস ঘটনা স্বচক্ষে দেখিয়াও তেমন কিছু করিতে পারে না। কেননা তাহারা জানেন-ইহাতে তেমন কিছু হইবে না, উলটা নিজেকে বিপদে পড়িতে হইবে। কেননা যাহারা সমাজে প্রভাবশালী, তাহারাই এই দুর্বৃত্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী। তাহা হইলে দেশে পরিবর্তনটা আসিল কোথায়?
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের রাজনীতি দিনদিন যে কদার্য রূপ ধারণ করিতেছে, তাহাতে মানুষের হতাশা শুধু বাড়িতেছে। সমাজের আইনকানুন-নিয়মের প্রতি মানুষের বিশ্বাস এই জন্য হারাইয়া যাইতেছে। যেই সমাজে মানুষকে মারিবার জন্য অল্প টাকায় লোক ভাড়া পাওয়া যায়, সেই সমাজে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ হইবে-এমন কথা জোর দিয়া আমরা কীভাবে বলিতে পারি? তাই আমরা মনে করি, আইন হাতে তুলিয়া লওয়ার প্রবণতা মারাত্মক। ইহা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। অতএব, দেশের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি জনস্বার্থে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ লওয়া অত্যাবশ্যক। (সম্পাদকীয় মন্তব্য:ইত্তেফাক)