।।রাজনৈতিক ভাষ্যকার।।
সংকট, কঠিন এক সংকটে বাংলাদেশ। যা কিনা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি। আর এই সংকট মোকাবিলায় সরকার আছে, নেই। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। টেবিলে নয়, প্রকাশ্যে। কিন্তু কেন। কী তাদের লক্ষ্য। অনেকে বলেন অস্পষ্ট, আবেগে ভরা। কিন্তু মোটেই তা নয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তারা হাঁটছেন ধারালো ছুরির উপর দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা নতুন ঘটনা না হলেও এবারেরটা অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক উল্টো স্রোতে।
একটি হত্যাকাণ্ড রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে অর্জনগুলো। কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন রাজনীতিকরা। এখানে আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যে ভাষায় কথা বলছে তা দেখে দূর থেকে আওয়ামী লীগ হাসছে। হাসছেন শেখ হাসিনা। যে শক্তি বঙ্গবন্ধুর ছবি ও ভাস্কর্য ভেঙেছে সেই শক্তিকেও দেখা গেল জিয়াউর রহমানকে অবমাননা করছে। কুৎসিত ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে।
কারা মারলো ব্যবসায়ী সোহাগকে? যেকোনো বিবেচনায় এটা নির্মম, নিষ্ঠুর। ঘুঁটি কোথায় বসে সাজানো হয়েছিল তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। এটা কি নিছক হত্যাকাণ্ড? নাকি রাজনীতির নোংরা কোনো খেলার অংশ। সময়ই বলে দেবে । তবে ক্রমেই খোলাসা হচ্ছে। বিএনপিকে কোণঠাসা করতেই এটা যে পরিকল্পিত খেলা এখন তা স্পষ্ট। এখানে বিএনপির দায় আছে । ৫ই আগস্টের পর দরজা খুলে দিয়েছিল । ময়লা-আবর্জনায় ডুবে গেছে দলটি। কে জানে কার কী উদ্দেশ্য। বিএনপি নেতারা সংখ্যা দেখেছেন। মানুষ দেখেননি। বলছি ত্যাগী আর সৎ মানুষের কথা। চাঁদাবাজ আর দখলবাজের দৌরাত্ম্য দেখে অনেকেই সতর্ক করেছিলেন। বিএনপি নেতারা তেমনটা আমলে নেননি। হাজী সেলিমের ক্যাডার যখন বিএনপির কাফেলায় যোগ দেয় তখন বোঝা উচিত ছিল নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো মতলব আছে। এই সোহাগ ছিল হাজী সেলিমের বিশ্বস্ত ক্যাডার। তাকেই পৈশাচিকভাবে হত্যা করে তারই বন্ধুরা। যারা একসঙ্গে চাঁদাবাজির নিশানা উড়িয়েছিল। কারা তাকে হত্যা করলো? কেনই বা করলো? তদন্ত হচ্ছে । ফলাফল হয়তো জানা যাবে না। কারণ এর পেছনে দেশি-বিদেশি ‘কালো হাত’ রয়েছে।
অভ্যুত্থানের শক্তিদের ভাগ করা যদি উদ্দেশ্য থাকে তাহলে অতি সহজে হিসাব মেলাতে পারবেন না। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বিএনপির গতি রোধ করা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। নির্বাচনকে অনিশ্চিত করা। এই তিন লক্ষ্যই হাসিল হয়েছে। মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। অভ্যুত্থানের ফসল কে ঘরে তুলবেন? একে অপরকে যে ভাষায় গালিগালাজ করছেন, রাজপথে আওয়াজ তুলছেন তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। প্রফেসর ইউনূসের ঐকমত্য কমিশনের বারোটা যে বেজে গেল। জামায়াত, এনসিপি আর বিএনপি কি একসঙ্গে এক টেবিলে বসবে? বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিস্তর ফারাক। সরকারের ভেতরের সরকার তৎপর হয়েছে। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার অতীত ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রমাণ হয়ে গেছে রিজওয়ানা তার অতীত থেকে বের হতে পারেননি। এতদিন তিনি আসল রূপ আড়াল করে রেখেছিলেন।
যাইহোক, এটা ঠিক উপদেষ্টাদের একাংশ খুশিতে বিগলিত। ক্ষুদ্র একটি অংশ নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত। প্রফেসর ইউনূস কী করছেন। তিনি একদম চুপচাপ। কোনো কথাই বলছেন না। লন্ডন বৈঠকের মধ্য দিয়ে রাজনীতি গুছিয়ে এনেছিলেন। সহমতকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কাফেলাভুক্ত করেছিলেন। এটা অনেকেই মানতে চাননি। রাজনীতির উপ-মহাদেশীয় খেলোয়াড়রা গোড়া থেকেই এই ঐক্য ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে ছিল সচেষ্ট। রাজপথে জামায়াত আর এনসিপির প্রতিক্রিয়া দেখে অনেকের মধ্যেই সেদিন সংশয় তৈরি হয়েছিল। বদলে গিয়েছিল রাজনীতির ভাষা। তারা সুযোগ খুঁজছিল এই সমঝোতা ভেঙে দেয়ার। সুযোগ তৈরি হলো। বলাবলি হচ্ছে, এটা কোনো গায়েবি সুযোগ নয়। একটি পরিকল্পিত ছকের অংশ মাত্র। খেলা শেষ হয়নি, আরো খেলা আছে। প্রফেসর ইউনূসের মূল লক্ষ্য নির্বাচন। যদিও তার সহকর্মীদের মধ্যে নানা খেলায় ক্ষমতা স্থায়ী করার চেষ্টাও প্রবল। তারা নির্বাচনবিরোধী স্রোতে হাওয়া দিচ্ছেন অনেকটা প্রকাশ্যে। কিন্তু প্রফেসর ইউনূস জেনেও না জানার ভান করছেন।
দিনের শেষে এতে কার লাভ, কার ক্ষতি! সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দেশের। গণতন্ত্রে উত্তরণের। সর্বোপরি প্রফেসর ইউনূসের। ক্ষমতা যত দীর্ঘ হবে জনবিচ্ছিন্ন হবেন তিনি। মস্তবড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তার জনপ্রিয়তা। এমনিতেই তার নীতি-কৌশল পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রশ্নবোধক হয়ে গেছে। তার অতীত সংশয়ে পড়েছে। ধারণা ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায়ও তার অস্তিত্ব সংকটে পড়বে না। এখন তার আনুগত্য নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। এ নিয়ে আম-ছালা হারাতে বসেছেন। দেশ পড়েছে মহাসংকটে। আর এটা তৈরি হয়েছে তার কিছু উপদেষ্টাদের অতি উৎসাহী চালে। সমালোচকরা বলছেন, এই মুহূর্তে কী দরকার ছিল- চীন পাকিস্তানকে নিয়ে জোট গঠনে এক টেবিলে বসা। যাইহোক, পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় তা এখনই বলা যাবে না। তবে প্রফেসর ইউনূসের সরকার যে সংকটে পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সঠিক সময়ে বাস্তব সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে বাংলাদেশ মাঝপথে আবারও হোঁচট খেতে পারে। যা আমরা কেউই চাই না। ঘরের শত্রু বিভীষণ তা আমরা সবাই জানি। প্রফেসর ইউনূস যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।(মানবজমিন)