অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস-এর অফিসিয়াল ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ১০ মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) দেশে ‘উল্লেখযোগ্য অপরাধ বৃদ্ধি পায়নি’ এবং প্রধান অপরাধের হার ‘স্থিতিশীল’ রয়েছে। যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের সরকারি তথ্য এই দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক চিত্র তুলে ধরেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে দেশে ৩,৫৫৪টি খুন এবং ৪,১০৫টি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা জনমনে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে।
ড. ইউনূসের দাবি ও পুলিশের তথ্য
ড. ইউনূস তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, “সাম্প্রতিক মিডিয়া রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে এ বছর অপরাধ তীব্রভাবে বেড়েছে, যা জনগণের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। তবে, সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই দাবি সম্পূর্ণরূপে সমর্থিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, গত ১০ মাসে প্রধান অপরাধের হার স্থিতিশীল রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি অপরাধের ঢেউয়ের লক্ষণ নয়; বরং কিছু গুরুতর অপরাধ কমছে বা স্থিতিশীল। শুধুমাত্র কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি দেখা গেছে।”
কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য এই দাবির বিপরীতে গুরুতর চিত্র তুলে ধরেছে। গত ১০ মাসে (সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) ৩,৫৫৪টি খুনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা দৈনিক গড়ে ১০টির বেশি খুনের ঘটনা নির্দেশ করে। এছাড়া, এই সময়ে ৪,১০৫টি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে মার্চ ২০২৫-এ ১৩২টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫৭টি ধর্ষণের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত। এই পরিসংখ্যান জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে ১১,০০৮টি অপরাধের ঘটনাও তুলে ধরেছে।
অপরাধের প্রকৃত চিত্র
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১,০৮,৬৯৫টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি, এবং মব ভায়োলেন্সের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ১,৫৮৭টি ডাকাতি, ৬৪৭টি সশস্ত্র ডাকাতি এবং পুলিশের উপর ৫২১টি হামলার ঘটনাও রিপোর্ট করা হয়েছে। এছাড়া, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৬ মাসে ২৫০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৪ জন নারী ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন, তিনজন আত্মহত্যা করেছেন।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ২৯৪টি খুনের মামলা দায়ের করা হয়, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ২৩১ থেকে বেড়েছে। এছাড়া, ডাকাতি (১৭১টি), অপহরণ (৫১ থেকে দ্বিগুণের বেশি), এবং ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা জানুয়ারি ২০২৫-এ সর্বোচ্চ ২৪২টিতে পৌঁছেছে। মব ভায়োলেন্সও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে, জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ৮৯ জন মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ৪৫টি ঘটনা খোদ রাজধানী ঢাকায়।
বিশেষজ্ঞ ও জনমত
অপরাধের এই উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান সত্ত্বেও ড. ইউনূসের দাবি যে অপরাধ ‘স্থিতিশীল’ রয়েছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, “ধর্ষণ ও খুনের মতো গুরুতর অপরাধের এই হার সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। সামাজিক কলঙ্ক এবং জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করতে নিরুৎসাহিত হন।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া ও জনসংযোগ) এনামুল হক সাগর দাবি করেন, “পুলিশ আন্তরিকভাবে অপরাধ দমনে কাজ করছে। ঘটনা ঘটলেই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শুধু পুলিশ নয়, সমাজ ও পরিবারেরও ভূমিকা রয়েছে।”
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনগণ সরকারের এই দাবির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অনেকে বলছেন, দৈনিক ১০টির বেশি খুন এবং ধর্ষণের উচ্চ হার সত্ত্বেও ‘অপরাধ স্থিতিশীল’ দাবি করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
সরকারি পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর পুলিশ বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম স্বীকার করেছেন, “আমরা ১০০ শতাংশ সফল হইনি, এমনকি ৫০ শতাংশও নয়।”
এছাড়া, গত বছরের রাজনৈতিক পালা-বদলের সময় লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ অপরাধীদের হাতে চলে যাওয়ায় অপরাধের তীব্রতা বেড়েছে বলে পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে একটি ২৪/৭ হটলাইন চালু করেছে বলে দাবি করেছে, যদিও এটা চালু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। একইসাথে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতির কথাও বলছে ইউনূস সরকার।
পক্ষান্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন প্রয়োগ নয়, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইনি প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
ড. ইউনূসের দাবি যে অপরাধের হার স্থিতিশীল রয়েছে, তা পুলিশের তথ্যের আলোকে প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১০ মাসে খুন-ধর্ষণসহ অপরাধের ব্যাপ্তি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যর্থতা তুলে ধরেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে দেশে নিরাপত্তাহীনতা আরও তীব্র হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।