।। শুভ কামাল।।
পরম করুণাময়ের কাছে শুকরিয়া তিনি যে গেঞ্জি জেনারেশনে জন্ম দেন নাই। হ্যাঁ আমরা মিলেনিয়াল।
আমরা বই পড়া শুরু করতাম কমিকস দিয়ে, তারপর তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা। আস্তে আস্তে ধরতাম উপন্যাস, কবিতা। কখনো কাঁদিয়ে, কখনো হাসিয়ে জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহমেদ, শাহরিয়ার কবিররা আমাদের হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিলেন এক বোধ। আমরা অবদমিত সময়ের মাঝ থেকে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসা এক প্রজন্ম। যখন টিভিতে রাজাকার শব্দটা বলা যেতো না, হুমায়ূন আহমেদ কৌশলে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে আমাদের প্রথম শুনিয়েছিলেন ‘তুই রাজাকার’ একটা গালি।
আমরা অনেকে স্কাউটস বিএনসিসি করতাম। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে কুচকাওয়াজ করতাম। ২১শে ফেব্রুয়ারীতে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যেতাম। ফুল চুরি করে তোড়া বানাতাম। বিজয় দিবসের ভোরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে স্কুলের ব্যান্ড দলের ড্রামের তালে তালে স্টেডিয়ামে কুচকাওয়াজ করতে করতে হঠাৎ আমাদের গায়ের রোঁম দাঁড়িয়ে যেত। কখনো ঝাপসা হয়ে যেত আমাদের চোখ।
আমাদের কোন ফোন, এমনকি টেপ রেকর্ডারও ছিলনা। নানা দিবসের অনুষ্ঠানে আমরা মাইকে শুনতাম দেশের গান- এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী পাড়ে। আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়… এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম, কত আনন্দ বেদনা মিলন বিরহ সংকটে… আজো এই গান শুনলে আমার চোখে পানি এসে পরে। আরেকটা গান আমার ভাল লাগতো বেশী- ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে। আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই, তাদের স্মৃতির চরণে। ছোটবেলা থেকেই আমার স্লো টাইপের গান ভাল লাগে।
গানের রাজনীতি তখন বুঝতাম না। আমাদের শৈশবে বেশি শোনা যেত একটা গান- ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ। জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’। আম্মার সাথে তার স্কুলের নানা প্রোগ্রামে উপজেলার অডিটোরিয়ামে গেলে এই গানটা তখন বেশি শুনতাম। যথারীতি ভালই লাগতো। পরে বুঝেছিলাম বিএনপি তখন ক্ষমতায় ছিল বলে এই গান- তবু তো দেশের গান! মাঝে মাঝে কোথাও থেকে দুই একবার শুনতাম ভেসে আসতো- জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়ই… নতুন সূর্য উঠার এই তো সময়! গান যাই হোক, অনুভূতি হতো একই।
আমাদের স্কুল জীবনে বিএনপি আওয়ামীলীগ দুই দলের ক্ষমতাই আমরা দেখেছি। কখনো কেউ ফিল করায়নি মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটা দলের ছিল। আমরা জানতাম এই বিষয়গুলা আমাদের দেশের। আমাদের সবার। আমাদের শৈশবের সাথে তাই এই বোধ মিশে গেছে। এ কি শুধু একটা যুদ্ধ ছিল? এখন বুঝি এর সাথে জড়িত ছিল প্রগতিশীলতার চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, সকলকে নিয়ে একসাথে চলার মত প্রেরণা। আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রে ছিল ৭১, যাকে কেন্দ্র করে আমরা সবাই এক জাতি হিসেবে বেড়ে উঠছিলাম।
হঠাৎ কোথাকার কোন গেঞ্জির দল এসে বলে আমাদের শৈশব নাকি মিছে ছিল। আমরা যা ঘিরে বড় হয়েছিলাম, বিকশিত হয়েছিলাম সব নাকি ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। মাদ্রাসায় পড়া কিছু ছেলে, যারা আমাদের এইসব অভিজ্ঞতার কিছুই পায়নি, যারা হয়তো জাতীয় সংগীতটাও ঠিক মত গায়নি তারা নাকি ঠিক করে দিবে আমরা কি ভাববো। আমাদের জেনারেশনের কিছু লোক যাদের আদর্শ ভাবতাম তারাও দেখলাম পেট্রোডলারের প্রভাবে অন্য সুরে গান গায়। আই ডোন্ট কেয়ার ইয়োর প্রোপাগান্ডা, আই ডোন্ট গিভ আ ফাক টু ইয়োর ফ্রেমড ন্যারেটিভ। যতদিন সেই গানগুলা শুনলে চোখ ঝাপসা হবে, যতদিন ওইসব স্মৃতি ভুলে না যাবো, ৭১ এর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলবে!