গোপালগঞ্জ জেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর রাজনৈতিক সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের হামলার পর সংঘর্ষ ও গুলিতে ৫ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) একটি প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান চালিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে সেখানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি।
প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসকের ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২১ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করে নিহত, আহত, আটক/গ্রেপ্তার হওয়া নাগরিকদের পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় নাগরিক এবং হাসপাতাল ও কারাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সমাবেশের দিন সকালে আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। পরবর্তীতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে এনসিপি নেতারা সমাবেশ করেন। নেতাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে এবং সংঘর্ষ পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং নির্বিচারে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে গুলিতে ৪ জন নিহত হন এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১ জন মারা যান। নিহতরা হলেন— দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), ইমন তালুকদার (১৭), সোহেল মোল্লা (৩২) এবং রমজান মুন্সী।
আসকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়নাতদন্ত ছাড়াই দ্রুত মরদেহ দাফনের জন্য নিহতদের পরিবারের ওপর চাপ দেওয়া হয়েছিল। পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর ২০ জুলাই পুলিশ দীপ্ত সাহা ছাড়া অন্য তিনজনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করায়, যা নতুন ধরনের হয়রানি বলে মনে করছে পরিবারগুলো। নিহত ইমনের পরিবার দাবি করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা যাকে আঘাত করছিল, সেই ছেলেটিই ইমন।
সংঘর্ষের পর ১৬ জুলাই রাত থেকে গোপালগঞ্জে কারফিউ ও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এই সময়ে নির্বিচারে নাগরিকদের আটক ও গ্রেপ্তার করার অভিযোগ উঠেছে, এমনকি অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। ২১ জুলাই পর্যন্ত ১৮টি শিশুকে (অপ্রাপ্তবয়স্ক) সন্ত্রাস বিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে আসক জানিয়েছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় ২১ জুলাই পর্যন্ত মোট ৮টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৬টি মামলার কপি আসকের হাতে এসেছে। এই মামলাগুলোতে ৫ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫৮ জন নামীয় আসামি। এদের মধ্যে ৩ জন নারী এবং ৩২ জন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন। বেশ কয়েকটি মামলা সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯-এর আওতায় করা হয়েছে। নিহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে, যদিও পরিবারগুলো দাবি করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
যদিও মামলা দুটির এজাহারে বর্ণিত বিবরণ অনুযায়ী, আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু পরিবারের সম্মতি না পাওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে ২৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ২১ জন সাধারণ নাগরিক এবং ২ জন পুলিশ সদস্য। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধদের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি।
২১ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে দায়িত্বরত জেল সুপার ও এআইজি (প্রিজন) আসক প্রতিনিধিদের জানান, ১৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে এবং ১৫০ জন বন্দীকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে, কারণ এখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দীর সংখ্যা তখন বেশি ছিল।
কারা কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, ১৬ জুলাই দুপুরে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কারাগারে হামলা চালিয়েছিল এবং সীমানা প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা করেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৮০ রাউন্ড ‘মিসফায়ার’ করা হয় এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসক প্রতিনিধিদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি এবং সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করেছে। তিনি জানান, ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এ ছাড়া ১৬ জুলাই রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আসক এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।