।। টি এম আহমেদ কায়সার ।।
একাত্তরের ভূমিকাই কি জামাতে ইসলামির সবচেয়ে বড় দায়? এজন্যে নি:শর্ত ক্ষমা চেয়ে নিলেই জামাতে ইসলামি পূত-পবিত্র হয়ে উঠবে?
ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার জন্যে জামাতে ইসলামি ফলত একটা ধর্মকে রীতিমত একখানা ক্ষুদ্র দলে নামিয়ে এনেছে – ইসলাম ধর্মের পয়গম্বর ও তার খলিফারা লড়েছিলেন পুরো ধর্মের জন্যে আর এরা লড়ছেন ধর্মের নামে নিজেদের মতবাদ, প্রকারান্তরে তাদের দল জামাতে ইসলামিকে প্রতিষ্ঠার জন্যে। দেশের ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মের নামে এই স্থূল রাজনৈতিক প্রতারণা ক্ষমা করে দেবে বলে মনে হয়? আমার হয় না – তা বিএনপি আওয়ামী লীগ যতই একাত্তর গণহত্যা, নি:শর্ত ক্ষমা ইত্যাদি কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর কথা বলে প্রকারান্তরে জামাতের রাজনীতিকে বৈধ করে তুলুক!
আমাদের রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হবে মানুষের তৈরি আইন দিয়ে – ভূল হবে, পরে ভুল থেকে শিখে শিখে মানুষই নির্ধারণ করবে নিজেদের জগতকে, আমাদের এই নশ্বর জীবনকে কিভাবে আরো সুন্দর, শ্রেয় ও বৈষম্যহীন করে তোলা যায়! স্বর্গ থেকে আমদানি হয়নি – মানুষ নিজেই একদিন আবিষ্কার করেছে আগুন এবং ধীরে তা মানুষের ব্যবহার্য করে তুলেছে – ফলে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, মিথ, রিচুয়াল ও প্রাচীন মনীষা থেকে মানুষ গ্রহণ বর্জন করে প্রতিনিয়তই শিখবে এবং শুধরাবে – এই প্রক্রিয়া মেনে মেনেই সভ্যতা চলবে তার নিজের গতিপথে…
পৃথিবীকে এই নিসর্গ, দৃশ্যমান এমনকি অদৃশ্য সব জীবজন্তরও বসবাস উপযোগী করে তোলার জন্যে এক অবিরাম লড়াই মানুষ চালিয়ে যাবে – জনগণ হবে সকল শক্তির মূল নিয়ন্তা – আর এটুকুই হবে সরল কথায় রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য! ধর্ম আপনি মানেন – ভাল কথা – তা যদি সমাজ প্রগতির অন্তরায় না হয় – রাষ্ট্র আপনার এই ব্যক্তি-সংস্কার, স্বতন্ত্র জীবনচর্যা বা আদর্শকে নির্বিঘ্নে পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করবে – এতটুকুই।
কিন্তু আসমানি কিতাবের তথাকথিত নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্র-পরিচালনা – উপরন্ত এমনই সব নির্দেশনা বা ধর্ম-প্রপঞ্চ যা আজকের মানব-জীবনকে, মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে, মানুষের এই নশ্বর জীবনের অভিজ্ঞতাকে জাহান্নাম করে তুলতে পারে এবং তা যদি করেও ( নি:শর্ত সমর্পণকারীর কাছে তা যতই জান্নাতি মনে হোক) তাকে ‘আসমান থেকে অবতীর্ণ’ বলেই ‘অনপনেয়’ ‘গসপেল’ ও ‘রদবদলহীন’ রাখতে হবে ‘মহাপ্রলয়’ পর্যন্ত – এহেন বিধানাবলী প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা রাজনীতি করছেন, এবং এমনকি এই ‘আসমানি বিধানাবলী’কে নিজেদের খেয়াল স্বার্থ অনুযায়ী বিবিধ ব্যাখ্যা তৈরি করে এই নিজ নিজ ভাষ্যকেই আবার ‘ঈশ্বরের অপরিহার্য নির্দেশনা’ বলে প্রচার করছেন, বিচিত্র সব বিশ্বাস ও হাজারো সব বর্গের মানুষের কাছে একে অবিধারিত, অপরিতাজ্য ও অনপনেয় করে তুলছেন, আজ একুশ শতকেও রাষ্ট্রপরিচালনায় এহেন ডগমাকে আপনি কি সত্যিই রাজনীতি বলে মানতে চাইবেন, বৈধতা দিতে চাইবেন? পারবেন?
একাত্তর নিয়ে ক্ষমা চাইলেন কি চাইলেন না – তা আজ মোটেও ধর্তব্য বলে মনে হয় না। বরং এহেন রাজনীতির অসারতার কথা বন্ধু, পরিবার বা জনগণের কাছে তুলে ধরুন – কোনো প্রকার জোর জবরদস্তি প্রয়োগ না করে। এই রাজনীতির মূলেই আছে – আমি আসমানি, আমিই সত্য আবার আমি অনপনেয়ও- এহেন চুড়ান্ত ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি – তাই এই মনোবৃত্তিকে সমাজে রাজনৈতিকভাবে (কিছুতেই শক্তি দিয়ে নয়) মোকাবেলা করতে না পারলে শুধু একাত্তরে তাদের ভূমিকার কথা বলে প্রকারান্তরে তাদের দায়মুক্তিও কিন্তু দিয়ে যাচ্ছেন, ফলে অপেক্ষা করুন – এর চেয়েও ভয়ানক সব ঘটনা অবিরাম ঘটতে থাকবে অচিরেই!
আসমানি কিতাবের দোহাই দিয়ে ক্ষমতার মসনদে আপনি আরোহন করতে চান অথচ এই আসমানি কিতাব যে সব ভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে সেসব দেশেই দেখুন শান্তির পরিবর্তে কী লেলিহান আগুন জ্বলছে, আর একটু ঘাটুন যদি হাতে সময় থাকে, এমনকি ‘খোলাফায়ে রাশিদীনে’র অমলেও হানাহানি বা যুদ্ধ বিগ্রহ কিছু কম সংঘটিত হয়নি।
কেতাবি ‘গসপেল’ ‘অরদযোগ্য’ শাসনতন্ত্র দিয়ে ধরাদামে কোনোদিনই স্বর্গ রচিত হয়নি, বোধকরি এজন্যে সমাজতন্ত্রের মত এত শক্তিশালী ধারণাও বিপুলভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জগতে আপাত শান্তি ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে যাদের জানি ( যে সব দেশের ভিসা পেলে আসমানি কিতাবের দেশ থেকেও এক লাত্থি দিয়ে পালিয়ে আসতে চাইবেন) তা রচিত হয়েছে মানুষের চিন্তা, অধ্যাবসায় ও ভূলগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে শিখে শিখেই।
জামাতে ইসলামির রাজনীতিই তো অপাংক্তেয় অপ্রয়োজনীয় ও একেবারেই অবসোলিট। একাত্তর খুবই খুবই খুবই সামান্য এক নমুনা মাত্র।