যা দেওয়ার শুরুতেই দেওয়া হয়েছে, এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে খুব বেশি ঢালাও মামলা নেই; তবে আগের মামলাগুলোর সমাধানও হয়নি। কারাগারে থাকা সাংবাদিকরা জামিনও পাচ্ছেন না।
এই এক বছরে গণমাধ্যমে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? জানতে চাইলে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এক অজানা ভয় পেয়ে বসেছে গণমাধ্যমকর্মীদের মনে। অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন বা আগে হারিয়েছেন। কারণ দৃশ্যমান নয়। এজেন্সির দাপট নেই, অন্যদের খবরদারি আছে অতি কৌশলে। আর মব সন্ত্রাসের ভয়ে অনেক কিছুই লেখা যাচ্ছে না, বলা যাচ্ছে না। এই হচ্ছে পরিবর্তনের অবস্থা। তবে এই মুহূর্তে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে না। শুরুতে অনেক মামলা হয়েছে, অনেকে কারাগারেও আছেন। খুব যে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে, সেটাও বলা যাবে না। আগের থেকে এখনকার অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না
এখন কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না বলে মনে করেন সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীর। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি মনে করি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি খর্ব হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে এক ধরনের ভীতি ছিল। এখন সরকারের কোন ভীতি নেই। সরকার কিন্তু বলছে না, এই লেখো, কেন লিখলে? কোন এজেন্সিও মিডিয়ার উপর খবরদারি করছে না। কিন্তু মিডিয়া নিজেই সেন্সরশিপ আরোপ করছে। তার কারণও আছে। এখানে মব ভায়লেন্সের কারণে সংবাদমাধ্যমের উপর এক ধরনের কর্তৃত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এরা সরকারেরই সমর্থন একটা গোষ্ঠী। তারা উগ্র ডানপন্থি।”
তিনি বলেন, “এই উগ্রবাদীরা প্রতিটি সেক্টরে গত সরকারের দোসর খুঁজছে। যারা সরকারকে প্রশ্ন করছে, তাদেরকে আওয়ামী দোসর ট্যাগ দিয়ে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিচ্ছে, তাদের চাকরিও যাচ্ছে। উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীকে প্রশ্ন করার কারণে ৩-৪ জন সাংবাদিকের চাকরিও গেছে। মব এর আগে বিভিন্ন হাউজের সামনে গিয়ে গরু জবাই করেছে। তারা জিয়াফত করে প্রেশার তৈরি করছে। ফলে প্রকৃত সাংবাদিকতা হচ্ছে না। যেটা হচ্ছে সেটা দৈনন্দিন রিপোর্ট হচ্ছে। বড় ধরনের কোন ইনভেস্টিগেশন (অনুসন্ধান) হচ্ছে না। গোপালগঞ্জে ৫ জন মারা গেল, তাদের নিয়ে মিডিয়া কোন মানবিক রিপোর্ট করল না। পোস্টমর্টেম ছাড়া তাদের লাশ দাফন করা হয়েছে, পরে তোলা হল। কয়েকদিন কারফিউ রাখা হলো মিডিয়া তো প্রশ্ন করল না?”
‘মব ভায়লেন্স’কে যত ভয়
গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করার পর তিন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। তিন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সে সময় ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, মূলত মব-সহিংসতার ভয়েই তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন তারা।
তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতিতে নিজেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে তখন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অজুহাত দিলেন, “মাস মার্ডার ডিনায়ালের সূক্ষ্ম চেষ্টা থেকে প্রেস কনফারেন্সে যে কথাগুলা বলেছেন তিন সাংবাদিক, সেটা জুলাই দেখেছে এমন যেকোনো সেনসিটিভ মানুষকেই আহত করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কেউ একজন হুমকি দিলো আর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে ফেললো – সেটা তো ঠিক না। এভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা হবে না।”
গত বছরের ১৮ই ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র (বৈছা) আন্দোলনের অন্যতম নেতা (বর্তমানে এনসিপি নেতা) হাসনাত আব্দুল্লাহ কয়েকজনকে নিয়ে সময় টিভির বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন এবং টিভি স্টেশনের ১০ জনের নামের একটি তালিকা দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করতে চাপ দেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী সময়ে সেই তালিকার ৫ জনকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলার পর তারা তাতে অস্বীকৃতি জানালে একই দিন হোয়াটসঅ্যাপে তাদের অব্যাহতিপত্র পাঠানো হয়।
তবে সিটি গ্রুপে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও সেখানে গিয়ে ভয় দেখানো বা তালিকা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
কয়েকদিন আগে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি করায় দৈনিক যুগান্তরের এক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।
সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আসলে সেই অর্থে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়নি। মুখে মুখে স্বাধীন। বাস্তবে কাঠামোটা যদি পরাধীন থাকে বা আগের নিয়মে থাকে তবে আমি যে স্বাধীন তার নিশ্চয়তা কোথায়? দেখবেন, মিডিয়া সংকুচিত। বিদ্যমান যে চ্যানেলগুলো আছে, সেখানে সবাই একই মতাদর্শের কথা বলছেন। ভিন্নমতের কেউ নেই। মালিকরা তাদের ডাকতে সাহস পাচ্ছে না। গত ১৫ বছরে যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল তাদের ডাকা হচ্ছে না। হয় তারা মবের ভয়ে আসছে না, অথবা মালিকরা মবের ভয়ে তাদের ডাকতে সাহস পাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “পরিবর্তনের পর চ্যানেলগুলো যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সংবাদপত্রের সামনে গরু জবাই হয়েছে ফলে সবাই সংকুচিত। এখনও মব সংস্কৃতি বন্ধ করা যায়নি। ফলে কার্যকরভাবে গণমাধ্যম স্বাধীন হয়েছে সেটা বলা যাবে না।”
এখনও কারাগারে ১৩ সাংবাদিক
জুলাই দাঙ্গায় খুন ও খুনের চেষ্টার মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৬৬ জন সাংবাদিককে। তাদের মধ্যে ১৩ জন আছেন কারাগারে।
গত ৪ঠা মে মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের আলোচনায় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমাদের জন্য অসম্মানের। এটার অর্থ এই নয় যে, কেউ দোষ করেননি। দোষ করে থাকলে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন এবং আমরা কোনোভাবেই তার পাশে দাঁড়াবো না। কিন্তু আজকে ৬-৭ মাস হয়েছে, তারা এসব মামলায় পড়েছেন। একটি কদমও এগোয়নি তদন্তের ব্যাপারে।”
তিনি আরও বলেন, “আইন উপদেষ্টা বলেনছেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার’ মেনে নিলাম মামলা করার অধিকার। কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কি সরকার কিছু করবে না? সেখানেই আমার বড় প্রশ্ন- যাদের নামে মামলা হয়েছে, সেসব সাংবাদিক একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন। তারা মব সন্ত্রাসের ভয়ে থাকেন। এ রকম দু-একটা ঘটনা ঘটেছে।”
যে ১৩ জন সাংবাদিক কারাগারে আছেন তাদের মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টেলিভিশনের তিন সাংবাদিক- সাবেক সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ও উপস্থাপক ফারজানা রুপার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে ডয়চে ভেলের। এদের মধ্যে মোজাম্মেল হক বাবু ক্যান্সারের রোগী। শ্যামল দত্ত স্লিপ অ্যাপনিয়ায় (ঘুমের মধ্যে সাময়িকভাবে দম আটকে যাওয়াসহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত জটিল রোগ) ভুগছেন বলে জানিয়েছে পরিবার। এছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরলসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগেও ভুগছেন তিনি। সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাও অসুস্থ বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবার।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন কতদূর?
গত মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার বিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ড. ইউনূসের কাছে। প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কীভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটাও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সরকারের দায়িত্ব এটা বাস্তবায়ন করার। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, যেগুলো এখনই করা সম্ভব, তা সরকার দ্রুত করে ফেলবে।”
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকার যে মিডিয়া সংস্কার কমিশন করেছিল, সেখানে আমিও ছিলাম। আমরা অনেক সুপারিশ করেছি। তার বাস্তবায়ন করা গেলে অনেকটা স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব। কিন্তু সেটা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে তা আমি জানি না। রিপোর্ট দিয়েছি, ৪-৫ মাস হয়ে গেল, এ নিয়ে কোন নড়াচড়া দেখছি না।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা দুই চারটা সুপারিশের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। ফলে এই রিপোর্ট আদৌ কোনদিন আলোর মুখ দেখবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।”