সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ ও ভিসা সোনার হরীণে পরিণত হয়েছে৷ জুলাই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইউনূস ক্ষমতা দখলের পর ভিসা প্রত্যাখ্যানের পরিসংখ্যান বেশি এবং ভিসা প্রাপ্তির শর্ত এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, অন্তত এক ডজন দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে অথবা অত্যন্ত উচ্চহারে আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে। পাকিস্তান বাদে অন্যান্য দেশ তাদের ভিসা প্রক্রিয়া শর্তসাপেক্ষে অত্যন্ত কঠিন করে দিয়েছে এবং শর্তপূরণ ও দূতাবাসগুলোর ধীর গতিতে ভিসা পাওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, লাওস, মিশর, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান সম্পূর্ণ ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর ইউনূস সরকার এবং জামায়াতের ইন্ডিয়া-আউট ক্যাম্পেইনের ফলে ভারত-বিদ্বেষ এবং একাত্তরে বাঙালি গণহত্যাকারী দেশ পাকিস্তানের সাথে ইউনূস সরকারের ঘনিষ্ঠতা দেখে চিকিৎসা ও শিক্ষা গন্তব্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় প্রতিবেশী ভারতও এখন সীমিতসংখ্যক ভিসা দিচ্ছে, শুধুমাত্র চিকিৎসা ও শিক্ষাগত ক্যাটাগরিতে।
উপসাগরীয় অঞ্চল ও মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং মালয়েশিয়া—বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তিনটি শ্রমবাজার—এখন অদক্ষ শ্রমিকদের ভিসা প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত তিন মাসে ৩৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করে মালয়েশিয়ার পুলিশ। আটককৃতরা বাংলাদেশ ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট বা আইএস সদস্যদের অর্থায়ন করতো এবং বাংলাদেশে আওয়ামী সরকার পতনে এদের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল।
২৭শে জুন, শুক্রবার কুয়ালালামপুরে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা তথ্য ও সমন্বিত অভিযানে জানা যায়, এই গ্রুপটি ইসলামিক স্টেট-এর চরমপন্থী বিশ্বাস নিয়ে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে এবং তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘রিক্রুটমেন্ট সেল’ গড়ে তোলে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং নিজ দেশে (বাংলাদেশে) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে (আওয়ামী লীগ) উৎখাতের প্রস্তুতি গ্রহণ।”
পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোও এখন ভিসা দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়াকরণে কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত সময় লাগছে, আর প্রত্যাখ্যানের হারও বেড়ে চলেছে। একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশিদের তিন শতাধিক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে, আশঙ্কা করা হচ্ছে সংখ্যাটি ২০২৫ সালে আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বোটঅফ) জানিয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে বহির্গামী পর্যটন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ এবং কর্পোরেট ভ্রমণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা ব্যাপক ভিসা বিধিনিষেধ এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করছেন।
বোটঅফ সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, “যদি নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা চলে, তাহলে অনেক ছোট ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে অনেকে কোভিডের সময়ের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে আছে।”
গত ১১ মাসে কর্পোরেট বহির্গামী ভ্রমণ স্বাভাবিক মাত্রার ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। ট্যুর অপারেটররা এর জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও কঠোর ভিসা নীতিকে দায়ী করছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ জালালউদ্দিন শিকদার বলেন, “গণতান্ত্রিক উত্তরণ ছাড়া ভিসা সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বিশেষ কোনো ফল আনেনি।”