যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর (ইউএসটিআর) আসন্ন শুল্ক আলোচনার জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি, যা দেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি খাতের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। গত ছয় মাস ধরে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক সফর এবং আলোচনা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে। এই ঘটনাকে অনেকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক দুর্বলতা এবং গোপনীয় ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ)-এর কারণে সৃষ্ট পরিণতি হিসেবে দেখছেন।
গত এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এই শুল্কের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে গত ৯ জুলাই ওয়াশিংটনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন ও ড. খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুল্ক কমানোর জন্য আলোচনা করা হলেও, কোনো ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়নি। অর্থনীতিবিদরা এই ব্যর্থতার জন্য আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের যোগ্যতা ও প্রস্তুতির ঘাটতির পাশাপাশি ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’-এর গোপনীয়তাকে দায়ী করছেন।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,
“গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়, যার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। এই গোপনীয়তার কারণে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলোচনা না করেই সরকার এগিয়েছে, যা আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থানকে দুর্বল করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই শুল্ক বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে, যা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস।”
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮.৪ বিলিয়ন ডলার, যার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। নতুন শুল্কের ফলে এই খাতে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অভাবে আমরা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছি। নতুন শুল্ক আমাদের অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।”
অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের দুর্বল প্রস্তুতি এবং গোপনীয় এনডিএ চুক্তির কারণে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের অবস্থানকে গুরুত্ব দেয়নি। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন,
“বেসরকারি খাত, যারা রপ্তানির মূল চালিকাশক্তি, তাদের সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এমনকি বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদেরও জড়িত করা হয়নি।” তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, “এনডিএ-এর গোপনীয়তার আড়ালে কী এমন আলোচনা হলো যে বাংলাদেশকে শুল্ক আলোচনা থেকে বাদ দেওয়া হলো?”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ শুধু বাণিজ্যিক নয়, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলেরও অংশ। একজন সাবেক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এনডিএ-এর গোপনীয়তা এবং আলোচনায় স্বচ্ছতার অভাব বাংলাদেশের দুর্বল কূটনৈতিক অবস্থানকে প্রকাশ করেছে।”
এদিকে, বাংলাদেশ সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক পুনর্বিবেচনার কথা জানালেও, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। আমরা আশা করছি, চলমান আলোচনা শুল্ক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে।” তবে, তিনি শুল্ক আলোচনা থেকে বাংলাদেশের বাদ পড়ার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার আগামী ২৬ জুলাই থেকে শুল্ক আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। তবে, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। শিল্প বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই শুল্ক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি তৈরি করবে, যা কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের কাছে এখন জরুরি প্রয়োজন কৌশলগত ও স্বচ্ছ আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা।