।। আরাফ হোসাইন।।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রথম গঠিত হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও ভারতের সহায়তায় দিল্লিতে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম পাইলট দলকেও প্রশিক্ষিত করে প্রস্তুত করা হয় ভারতের সহযোগিতা নিয়ে। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে আকাশপথের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী (BAF) গঠন করে। পরবর্তীতে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং রাশিয়ার সহায়তায় অল্প কিছু বোমাবর্ষণকারী ও নজরদারি বিমান এবং পরিবহন হেলিকপ্টার নিয়ে BAF যাত্রা শুরু করে।
এই যাত্রায় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের জন্য ১৯৭৭ সালে প্রথম সিঙ্গেল রোল ফাইটার যুদ্ধবিমান Shenyang f-6 টাইপ ৩০টির মতো কেনা হয়েছিল চীন থেকে জিয়াউর রহমানের আমলে; যা রাশিয়ান মিগ-১৯ এর চায়নিজ কপি। এরপর ১৯৮৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে চীনের চেংদু সিরিজের F-7M টাইপ কিছু বিমান কেনেন। যা এখন বাতিল হয়ে ডকে আর কিছু জাদুঘরে রাখা হয়েছে। ১৯৯১-৯৬ সালের খালেদা জিয়ার আমলে মাত্র ৮টি গ্রাউন্ড অ্যাট্যাক বিমান ও দেড় ডজন প্রশিক্ষণ বিমান যোগ হয়েছিল এবং সেসব ক্রাফট বহু আগেই সার্ভিস থেকে বিদায় নিয়েছে।
‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত এই স্লোগানকে মূলমন্ত্র ধরে প্রশিক্ষন নেয়া বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বর্তমান বহরে মাল্টিরোল ফাইটার, ট্রেইনিং, রেসকিউ এবং হেলিকপ্টার মিলিয়ে অ্যাক্টিভ এয়ারক্রাফট আছে সর্বমোট ২১২টি/২১৪টি। যার মধ্যে যুদ্ধবিমান ৫০ থেকে ৬০ টি ( Mig29, F-7 BG/BGi, Yak130, k8 মিলিয়ে) এবং প্রশিক্ষণ বিমান ৪০ থেকে ৮০টির মতো, হেলিকপ্টার আছে ৫৫/৬৫টি ও ১৪টির মতো পরিবহন বিমান।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সার্ভিসে যতগুলো যুদ্ধবিমান আছে তার মধ্যে একমাত্র মাল্টিরোল ফাইটার হিসেবে Mig 29 আছে ৮টি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করলে দেশের জন্য প্রথমবারের মতো এতো উন্নত ও বিমানবাহিনীর বহুমাত্রিক শক্তিবৃদ্ধিতে অতি প্রয়োজনীয় এই বিমানগুলো আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ নিয়ে রাশিয়া থেকে কেনে ১৯৯৯ সালের দিকে।
এরপরের পাচঁ বছরে তথা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জোট সরকারের আমলে এয়ারফোর্সের বহরে কোনো ধরনের নতুন বিমান যোগ হয়নি। এমনকি সেসময়ে দেশের আকাশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ফাইটার বিমানগুলো ওড়ার অনুমোদন এবং পরিচালনা করা পর্যন্ত সীমিত করে দেয় নানান অযুহাতে।
তারপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে সক্ষমতায় ছোট হয়ে আসা বিমান বাহিনীর বহরকে সমৃদ্ধ ও আধুনিকায়নে ২০১১ সালে বিমানবাহিনীর জন্য নতুন করে চীনের তৈরি Chengdu F7 সিরিজের সবচাইতে আধুনিক কমব্যাট ফাইটার F7-BGI ১৬টি যুক্ত করে।
সেই ধারবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলে ২০১৪ সালে আবারও রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ এবং লাইট কমব্যাটের জন্য উপযোগী, আধুনিক ককপিট সমৃদ্ধ Yak-130 সিরিজের ২৪টি বিমান কেনে। এই বিমান কেনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো পাইলটদেরকে সুখোই থার্টি, এফ-থার্টি ফাইভ, জে-১০ মতো নিউ জেনারেশনের অত্যাধুনিক ফাইটার ক্রাফট চালানোর জন্য দক্ষ করে তোলা।
২০১৮ সালে চীন এবং পাকিস্তানের যৌথভাবে তৈরি একইসাথে যুদ্ধসক্ষম ও জেট ট্রেইনার বিমান টাইপ K-8W সিরিজের ১৬টি বিমান কেনার অর্ডার দেয় যা পরবর্তীতে ডেলিভারি পায়। সাথে প্রাথমিক ট্রেইনার ক্রাফট হিসেবে ২০২১ সালে জার্মানি থেকে আধুনিক ২৪টি GROB G- 120TP মডেল দেশে আনা হয়।
এছাড়াও ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে একের পর এক যুক্ত হয়েছে;
২০১৭ সালে অর্ডারকৃত বৃটেনের তৈরি ৫টি C-J130 সুপার হারকিউলিস পরিবহন বিমান
রাশিয়ার তৈরি ২১টির বেশি আক্রমণ ও পরিবহন সক্ষম Mi-17 হেলিকপ্টার
ইতালির তৈরি একাধিক সার্চ & রেসকিউ এর জন্য AW-139 হেলিকপ্টার
রাশিয়ার তৈরি প্রশিক্ষণ হেলিকপ্টার BELL 206 এবং AW-119KX মডেলের হেলিকপ্টারগুলো
পাশাপাশি সার্ভিসে থাকা প্রধান ফাইটার MiG-29 সহ অন্যান্য বিমান ও হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীয় আপগ্রেডেশন ও যন্ত্রাংশের পরিবর্তন নিয়মিত রেখেছে।
অর্থাৎ বলা যায়, দেশের আকাশ নিরাপত্তা ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মেইন এয়ারক্রাফট স্কোয়াড এবং সার্বিক সক্ষমতার তিন-চতুর্থাংশই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ানো অর্জন।
এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে সামরিক বাহিনীকে জল,স্থল ও আকাশ এই তিন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ফোর্সেস গোল ২০৩০ এর ঘোষণা দিয়েছিলো। সে লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকার বিমানবাহিনীর জন্য ফ্রান্স থেকে Rafale, ইউরোপের তৈরি EuroTyphoon, রাশিয়ার Sukhoi 30, চীনের তৈরি J-10C মডেলের অত্যাধুনিক মাল্টিরোল ফাইটার কেনার পরিকল্পনা রেখে অগ্রসর হয়।
প্রশ্ন’ এই তালিকায় মার্কিন কোনো বিমান নেই কেন? কারণটা হলো মার্কিন বিমান ব্যবহারে নানান কর্তৃত্ববাদী শর্তাবলী এবং ক্রয় জটিলতার মতো নানান দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে আমলে নিয়েই।
পুরো তথ্যপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের অতীতের সকল সরকারের আমলে আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য কেনা বেশিরভাগ অস্ত্রসামগ্রীতে সহজ সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় অন্যান্য দেশের তুলনায় চীনের আধিক্য ও নির্ভরশীলতা থাকে। এখন তাহলে মাইক্রোফাইন্যান্স গাই ও অন্তবর্তী সরকার প্রধান ড. ইউনূস সরকারের অস্ত্রনীতি কেনো এককভাবে পেন্টাগনের পথে?
প্রথমত, ইউনূস আমেরিকান ডিপ স্টেটের হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনীয় অস্ত্রের আমদানি চুক্তিতে তার ভাই-বেরাদরদের লাভের অংশীদার করতে চান। দ্বিতীয়ত, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুরোনো চক্ষুশূল হতে বাঁচতে মার্কিন অস্ত্র কিনে ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ নীতির পারপার্স সার্ভ করা। তৃতীয়ত হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চাপিয়ে দেয়া ট্যারিফ রেট! যা ব্যালেন্স করার জন্য আমেরিকা থেকে বেশি দামে যেমন গম কেনার কথা বলা হয়, সে আলোকেই অধিক দামে সমরাস্ত্র চুক্তি করবে।
এ কারণেই দেখা যায়, চলমান অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগাতে ইউনূস সরকার ও তার ভাড়াটে বাহিনী এবং মার্কিন পেইড অ্যাক্টিভিটিস্টরা মিলেমিশে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর ক্রয় ত্রুটির দায় চাপিয়ে মার্কিন অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রপট তৈরির প্রচেষ্টা ও প্রচারণায় নিয়োজিত।
লেখক পরিচিতি: গণমাধ্যমকর্মী