।। এস এম মাসুম বিল্লাহ।।
সাবেক প্রধান বিচারপতিকে কেন গ্রেফতার, এবিএম খায়রুল হক কি আসলেই আইন বহির্ভূত রায় দিয়েছিলেন?
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তিনি অপরাধ করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে কেন গ্রেফতার, এবিএম খায়রুল হক কি আসলেই আইন বহির্ভূত রায় দিয়েছিলেন?
রায় লেখার জন্য বিচারপতিকে গ্রেফতার করা যে কোনও আইনি মানদন্ডে নিন্দনীয় এবং পরিত্যাজ্য। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য একটি অশনি সংকেত। বিচারিক সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এটি একটি কলঙ্কের তিলক। বাঙলা একটা লোকগান আছে এরকম: আমার লাভের মাঝে কি লাভ হইল গলাতে কলঙ্কের দাগ!
বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তিনি অপরাধ করেছেন। আসলেই কি তাই?
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৯৬ সালেই সৈয়দ মশিউর রহমান নামের একজন আইনজীবী আদালতে নালিশ করেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিচারপতি মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি এমএ মতিন রিটটি সংক্ষেপে খারিজ করে দেন। যুক্তি হলো, ১৩-তম সংশোধনী সংবিধান থেকে কোনো কিছু বাদ দেয়নি। এটি কম সময়ের জন্য একটি নির্বাচন ব্যবস্থা আয়োজন করেছে আর প্রচলিত নির্বাহী বিভাগের বিধান কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখেছে মাত্র।
এরকম নালিশ আবার আদালতে আসে ১৯৯৯ সালে, সলিমুল্লাহ নামের একজন আইনজীবীর উদ্যোগে। রিটের নিস্পত্তি হতে হতে ২০০৫ সাল এসে যায়। রিটের প্রথম শুনানি হয় ২০০৩ সালে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান এবং বিচারপতি আওলাদ আলির বেঞ্চে। কিন্তু তখন কোনও আদেশ হয়নি। হাইকোর্ট বিভাগে তিনজন বিচারক যথা বিচারপতি এম আওলাদ আলি, বিচারপতি জয়নাল আবেদিন এবং বিচারপতি মির্জ্জা হোসেইন হায়দার একমত হয়ে বলেন যে, কেয়ারটেকার সিস্টেম ঠিকই আছে। বিচারপতি আওলাদ আলি এই ব্যবস্থাকে ‘পিকুলিয়ার এবং নভেল’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই তিন বিচারকের রলিংয়ের মূল কথা ছিল, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা ‘গণতন্ত্রের উৎকর্ষ সাধন করেছে।’
কিন্তু কীভাবে গণতন্ত্রের উৎকর্ষ হয়েছে তাঁর কোনও উদহারণ ওই মতামতগুলিতে নেই। শুধু নির্বাচন শ্রেয়তর ভাল হয়েছে এই জন্য গণতন্ত্রের উৎকর্ষ হয়ে গ্যাছে তা বলা যায় না। তাই যদি হতো তাহলে ২০০১-এর নির্বাচনোত্তরকালে হিন্দু-সম্প্রদায়ের উপর সিস্টেম্যাটিক ও ব্যাপক নিগ্রহ হতো না।
আবার ওই মামলার আপিল যদি ২০০৬-এর রাজনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার আগেই নিস্পত্তি হয়ে যেত, হয়তো আদালত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক ও বৈধ হিসেবেই রেখে দিতেন! কে জানে! সময় ও সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনা, আবেগ ও ঝোঁক দ্বারা আদালত ঋদ্ধ বা প্রভাবিত হন (contemporanea expositio)।
২০০১-২০০৬ বাংলাদেশের জীবনে এক অন্ধবিন্দু যেনো! দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলা এবং ২০০৪ এর ২১ অগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা হামলা এই সময়ের বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থতার শেষ বিন্দুতে নিয়ে যায়। এরই মাঝে আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ মস্তিস্কপ্রসূত বেশ কিছু সাংবিধানিক বিচ্যুতির নাম করা যেতে পারে:
১) আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনানি করার জন্য প্রয়োজনীয় বিচারপতি নিয়োগ ছয় বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া এবং ২) অসৎ উদ্দেশ্যে বিচারপতিদের অবসরের বয়স দুই বছর (৬৫ থেকে ৬৭) এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন, বিএনপি মননের বিচারপতি কেএম হাসান তদারকি সরকারের প্রধান হতে পারেন। অভিজ্ঞতা বলে, আইনমন্ত্রীদের কারণে আমাদের দেশে যুগে যুগে বিভিন্ন সরকারকে বিপদে পড়তে হয়েছে এবং জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
এম সলিমুল্লাহর মামলাটি ২০০৯ সালে নিস্পত্তির জন্য আপিল বিভাগে আসে। তখন রিটকারী এম সলিমুল্লাহ আর বেঁচে নেই। তাঁর জায়গায় বাদী/আবেদনকারী হিসেবে জায়গা নেন আব্দুল মান্নান খান নামের একজন আইনজীবী। সে থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার কেতাবি নাম হয় আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ। মামলাটি ৬৪ ডিএলআর (২০১২) ১৬৯ পাতায় বিধৃত আছে, এবং কেয়ারটেকার সরকার বাতিল মামলা নামে বাজারে জারি আছে।
সাতজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক রিটের আপিল শোনেন। চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। তবে তিনজন বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করেন। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ৪-৩ ভোটে সংবিধান সম্মত নয় বলে সাব্যস্ত হয়।
সংখ্যাগুরুদের পক্ষে প্রধান রায়টি লেখেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বিচারপতি এসকে সিনহা সহমত দিলেও আলাদা মতামত দিয়ে রায় লেখেন। অপর দুইজন শুধুই সহমত পোষণ করেন।
সংখ্যালঘিষ্ঠ মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় মতামত লেখেন বিচারপতি এমএ ওয়াহ্হাব মিয়াঁ। তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করে রায় লেখেন বিচারপতি এম ইমান আলি, আর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা শুধু ভিন্নমতে সহমত প্রকাশ করে সই দেন।
এই বিভক্তি রায় প্রমাণ করে যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে কনটেস্টেড ইস্যু এবং এর অবস্থান নির্ণয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মামলাটিতে আপিল বিভাগে আবেদনকারীর আইনজীবী এমআই ফারুকি এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি-জেনারেল মাহবুবে আলম ছাড়াও দেশের স্বনামধন্য আট জন আইনজীবী আদালত বন্ধু বা এমিকাস কিউরি হিসেবে যুক্তিতক্ক উপাস্থাপন করেন। তাঁরা হলেন: ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ড. এম জহির, বিচারপতি টি এইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর -ঊল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। আজমালুল হোসেন কিউসি দ্ব্যর্থহীনভাবে কেয়ারটেকার সিস্টেমকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক হিসেবে নিবেদন করেন। অন্যদের উপস্থাপনে দোলাচল ও বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়।
বেশিরভাগ এমিকাস কিউরি বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সংবিধানিকতা যাচাইয়ের জন্য বলেন। ড. কামাল হোসেন তিনটি কারণে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সাংবিধানিক বলে যুক্তি দেন: ১) এই ব্যবস্থা ১৯৯৬-এ রাজনৌতিক মতৈক্যের ফল। ২) এই ব্যবস্থা মৌলিক কাঠামো ‘গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়, বরং মৌলিক কাঠামো হিসেবে গণতন্ত্র যাতে করে অর্থপূর্ণ ও শক্তিশালী হতে পারে তার একটি অনুষঙ্গ; এবং ৩) এই ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, কেননা সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতিই একমাত্র বিকল্প নন।
ড. হোসেনের তিনটি যুক্তিই অত্যন্ত সাধারণমানের বলে ঠাওর হয়। এমনকী বিচারবিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁর দেওয়া যুক্তি তাঁর বিপক্ষে গেছে বলে জাস্টিস সিনহা তাঁর রায়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।
প্রথমত, আমি আমার অন্যত্র একটি লেখায় দেখিয়েছি যে, ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক কোনও ঐকমত্যের ফসল ছিলনা, এটি ছিল বিএনপির তরফে একটি আনউইলিং কনসেশন; দ্বিতীয়ত, পার্লামেন্ট প্রসিডিংসের দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এই ব্যবস্থা কোনওকালেই গণতন্ত্রকে তেমন ঋদ্ধ করেনি। তৃতীয়ত, নিজেদের প্রিয় সাবেক বিচারপতিকে চাকা ঘুরায়ে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার মতো অবস্থানে আনার জন্যে সিনিয়র বিচারপতিকে ডিঙানোর সংস্কৃতি বিএনপি চালু করে (এবং ২০০৯-এ এসে আওয়ামীলীগ এই ধারা অব্যাহত রাখে)।
খুব সম্ভবত এ কারণেই, মাহমুদুল ইসলাম তাঁর সাবমিশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হবার হাতছানিকে একজন প্রধান বিচারপতির জন্য ঝুলন্ত মুলা বা ‘ড্যাঙলিং ক্যারোট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ড্যাঙলিং কারোট নিয়ে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া ও বিচারপতি এম ইমান আলি বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন বলে রায় পড়ে মনে হয়।
ড. এম জহির কেয়ারটেকার সিস্টেমকে ‘নখদন্তহীন বাঘ’, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র-বিরোধী’, ‘রাজনীতিকদের সততার উপর কলঙ্কের প্রাকৃতিক তিলক’ হিসেবে আখ্যা দেন। ব্যারিস্টার আমীর ‘পলিটিক্যাল জাস্টিসের’ আর্গুমেন্ট আনেন এবং বলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা আছে। এভাবে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্যাঙটিটি ও প্রেক্ষিতকে পানির দরে খরচ করে ফেলেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে বলতে গিয়ে। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে, এই ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলে দেয়।
ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেন, কেয়ারটেকার হলো প্রয়োজনীয় শয়তান (নেসেসারি ইভিল)– এটি দরকার, কিন্তু সংবিধানের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। টিএইচ খান তিনি নিজে ও তাঁর বিএনপির সহকর্মীরা ১৯৯৬-এ উত্থাপিত বিলটি খসড়া করেছিলেন বলে আবেগ প্রকাশ করেন এবং এর ভাগ্য সংসদের উপর ছেড়ে দিতে বলেন। মাহমুদুল ইসলাম শুরুতেই বলেন যে, স্বল্পায়ু সংসদে পাশ হওয়া আইন ভালো হবে না এটাই স্বাভাবিক। মাহমুদুল ইসলাম আশ্চর্যজনকভাবে এর পরে বলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করে না এবং কোনও সিস্টেম অপব্যবহার হলেই নাকি বেআইনি হয়ে যায় না।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সমর্থন করেন। কিন্তু বলেন যে, ২০০৪ সালে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো ছিল ‘বেঠিক সময়ে বেঠিক উপায়ে’ করা একটি কাজ। আজমালুল হোসেন কিউসি গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র এবং বিচারবিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে মানানসই নয় বিধায় কেয়ারটেকার সিস্টেমকে বেআইনি হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সুতরাং তিনি বলেন প্রথমত রাজনৈতিক সরকারই কাম্য। এবং তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন করানোর মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামো গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেন।
খেয়াল করলে দেখা যায় যে, এমিকাস কিউরিদের বক্তব্যে দোলাচল আছে। তাঁদের কথা অনেকটা এরকম: আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি আজ বৃষ্টি হতেও পারে, নাও পারে!
আমি হিসেব করে দেখেছি, বিচারপতি খায়রুল হক নিজস্ব যুক্তির পাশাপাশি প্রায় সব এমিকাস কিউরির বক্তব্য তাঁর রায়ে সম্মিলন ঘটিয়েছেন।
সুতরাং প্রচলিত ধারণা সঠিক নয় যে, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত উপেক্ষা করেছেন। আর বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া ড. কামাল হোসেনের মত, টিএইচ খানের মত এবং কিছুটা মাহমুদুল ইসলামের মত প্রতিফলিত করে রায় দিয়েছেন।
বিচারপতি খায়রুল হক
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সবচেয়ে দীর্ঘ মতামত দিয়েছেন। তাঁর জাজমেন্ট পড়ার অসুবিধা হলো তিনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যান বলে পাঠকের মনোসংযোগে চিড় ধরে। তাঁর জাজমেন্টটি অসংখ্য ছোট বড় অনুচ্ছেদে সাজানো। এর মধ্যে এক বাক্যের অনুচ্ছেদও আছে। সবার বোধগম্যতার জন্য তিনি রায়টি বাঙলায় লিখেছেন। তবে সেটি ইংরেজি বাঙলা মিশ্রণ ঘটায় আবেদন হারিয়েছে। একই কথার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় খামাখা এর দৈর্ঘ্য বেড়েছে। অনেক সময় অনুচ্ছেদান্তরে যেতে বক্তব্যের ছন্দপতন ঘটেছে। তবে কাঁটা বেছে পড়তে পারলে রায়টি অনেকের কাছেই ‘ভোলুমিনাস’ থেকে ‘লুমিনাস’ মনে হতে পারে।
বাংলায় এবং বড় কলেবরে জাজমেন্ট লেখা নিয়ে বিচারপতি ইমান আলি বিচারপতি খায়রুল হককে আলতো করে খোঁচা দিয়েছেন, যদিও বিচারপতি আলিও এক পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের ‘একিলিস হিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিচারপতি আলি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়কে “ম্যাগনাম অপুস”, বিশ্ব সংসার থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজে আনা “কপিয়াস রেফারেন্স” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি বাংলা জাজমেন্টও বিচারপতি হকের গ্রামের মানুষ বা শহরের মানুষ পড়বে কিনা, পড়লেও বুঝবে কিনা তা নিয়ে বিচারপতি আলি সংশয় প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে বলা যায়, প্রথমত এই কথাটি বিচারপতি আলি না লিখলেও পারতেন, দ্বিতীয়ত, নিয়তির পরিহাস! আসলেই বিচারপতি হকের জাজমেন্ট খুব বেশি মানুষ পড়েন বা পড়েছেন বলে মনে হয়না। বিশেষ করে, আমাদের গণমাধ্যম ঘুরেফিরে হাতেগোনা কয়েকজন ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ নির্মিতি থেকে বের হতে পারেন না। তাঁদের মতামত দ্বারা পুরো সমাজ দারুণভাবে বিভ্রান্ত হয়।
বিচারপতি খায়রুল হক প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের জনগণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের প্রতিনিধিত্ব, সংসদের জবাবদিহিতা, বিচারিক যাচাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা, এবং বিচারকের মন ইত্যাদি প্রশ্নে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তাভারানত থেকেছেন সারা রায় জুড়ে। এই সকল ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট আবেগিক, প্রাণঘণ, তাত্ত্বিক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন এবং পৃথিবীর তাবৎ জুডিশিয়াল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লিটারেচার থেকে ধার করে দারুণ কিছু জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন। আমার ভাষা ও মুল্যায়নযোগে তাঁর রায় থেকে কিছু যুক্তি, কথা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি:
১. বিচারপতি খায়রুল হক নিরপেক্ষ আইন পরামর্শকদের (amicus curae) কাছ থেকে দু’টি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর পাননি। ২০০৫ সালের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির রায়েও এগুলোর উত্তর মেলেনা। প্রথম প্রশ্নটি আমার মতো করে লিখছি। কথাটা এইরকম, বুঝলাম যে, কেয়ারটেকার সরকার গণতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি করে, তাহলে, সংবিধানের ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ একত্র করে রাষ্ট্রের যে জনগণতান্ত্রিক চরিত্র ধরা পড়ে, তত্ত্বাবধায়কের আমলের তিন মাসে (এবং কোনকোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি) সেই চরিত্রের সাংবিধানিক মান কী হবে?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কয়টা মেয়াদের জন্য হবে? এর উত্তরে শুধু বিচারপতি টিএইচ খান ক্যাজুয়ালি উপস্থিত উত্তর দিয়েছিলেন: পঞ্চাশ বছর। ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখায় সম্ভবত তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে করার বোঝাপড়া ছিল।
বিচারপতি খায়রুল হ্যামলেট রূপক টেনেছেন। তিনি লিখছেন: গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলো ‘প্রিন্স অব হ্যামলেটকে বর্জন করিয়া হ্যামলেট নাটক মঞ্চস্থ করার মতো।’ যথার্থভাবেই, গণতন্ত্রে প্রকৃত নায়ক জনগণ।
২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন। প্রতিরক্ষা প্রধান, অধ্যাদেশ ও জরুরি অবস্থা জারি, মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ ইত্যাদি ক্ষমতা অনুশীলনে তখন তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। যেটা প্রচলিত পুরো সাংবিধানিক কাঠামোকে তছনছ করে দেয়। যে ক্ষমতা এমনকী ১৯৭২-এর আদি সংবিধানও রাষ্ট্রপতিকে দেয়নি। তাই-ই ১৩-তম সংশোধনী রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে।
৩. জনগণের সার্বভৌমত্ব দানের সামগ্রী নয়, যখন খুশি দিলাম, যখন খুশি নিয়ে নিলাম। ভারত ১০৫ বার আর আমেরিকা ২৭ বার সংবিধানে সংশোধনী এনেছে। কিন্তু একবারও তারা জনগণের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়নি।
৪. আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জুডিশিয়াল রিভিউ, মৌলিক কাঠামো–এগুলোতে কোনো সংশোধনী আঘাত হানলে গার্ডিয়ান হিসেবে কোর্ট সেই সংশোধনীকে আদালত বেআইনি ঘোষণা করবেন সেটাই স্বাভাবিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে আঘাত হেনেছে।
৫. সরকার সংসদের কাছে জবাবদিহি করবেন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার কাছে জবাবদিহি করবেন? সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদ বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক/তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান মতে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। আবার একই সংযোগে ৫৫ (৩) এ বলা আছে যে, মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী। সংসদের নিকট এই দায়বদ্ধতা জনগণের ক্ষমতার অভিব্যক্তি।
তাহলে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা ওই তিনমাস কার কাছে দায়ী?
শুধু ‘মুটাডিস্-মুটেন্ডিস’ (আগের ক্ষেত্রে যেমন, এই ক্ষেত্রেও তেমন) প্রয়োগ হবে এরকম বলে দিলেই কথাটা ক্লিয়ার হয়না। সংবিধান কোনও পুলিশ ম্যানুয়াল তো নয়। বিচারপতি খায়রুলের মতে ‘উপদেষ্টা নমস্য ব্যক্তি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর পার্থক্য আকাশসম।’
৭. ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ কোনও নির্বাচনই হেরে যাওয়া দল মেনে নেয়নি। যতদিন গেছে অবস্থার তত অবনতি হয়েছে। ২০ মে ১৯৯৬ রাজপথে ট্যাংক দেখা গেছে, ২০০১-এ বিচারপতি লতিফুর দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ত্রিশ মিনিটেই ১০ জন সচিবকে দায়িত্বে আসার আগের করা ‘হোম ওয়ার্কে’ ওএসডি করা হয়েছে। চতুর্দশ সংশোধনী করে বিচারপতিদের অবসরের মেয়াদ বাড়ানো হয়, যাতে করে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হতে পারেন। আর ২০০৬-এ নানান সংকট তৈরি করে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টা বনে যান এবং হাওয়া ভবনের কথায় চলতে থাকেন। দুর্বল চিত্তের নতজানু লোক রাষ্ট্রের বিপদ ডেকে আনতে পারেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন —এর জ্বলন্ত প্রমাণ। রাষ্ট্রের যে ক্ষতি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ করে গেছেন তা আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
৮. এসব যুক্তিতে বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। তবে যেহেতু এই ব্যবস্থার অধীনে তিনটি নির্বাচন (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেগুলো বৈধ থাকবে। অবৈধতা ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকরী হবে (ধরে নিন আপনি ১৯৯৯-এ দাঁড়িয়ে আছেন)। অর্থাৎ এটি আপিল রায় হওয়ার তারিখ থেকে অবৈধ (১০ মে ২০১১ থেকে)। ইংরেজিতে এই মতবাদের নাম ডকট্রিন অব প্রস্পেক্টিভ ওভাররুলিং (ভবিষ্য সাপেক্ষ বাতিল)।
৯. ভবিষ্য সাপেক্ষ বাতিলের পরও বিচারপতি খায়রুল হক অনেকটা যেচে বলেছেন যে, ২০১১-এর পরও দুটি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হতে পারে (পড়ুন হতে পারতো)। এইখানে অনেকের মতে রায়টির হঠাৎ ছন্দ পতন ঘটেছে। দুটি নির্বাচন অবশ্য হওয়ার পরামর্শ দিতে তিনি কতকগুলো ল্যাটিন প্রবাদের সাহায্য নিয়েছেন। যা একবাক্যে শেষ হয়েছে।
যাহোক, আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করলে সেটা কোন গ্রাউন্ডে হবে তা তিনি বলে দিয়েছেন। তাঁর দেখানো কারণগুলো হলো: প্রয়োজন, নিরাপত্তা, এমিকাস কিউরিদের প্রজ্ঞাকে সম্মান জানানো এবং সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার। কিন্তু সেটা জানিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি ন্যায্য ও অন্যায্য কারণে রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হওয়ার কথা বলতে গিয়ে অবশ্য তিনি দু’টি শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন: পার্লামেন্টকেই এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এবং সর্বশেষ বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখা যাবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আরও একটি সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনের ভবিষ্য প্রধান হিসেবে তিনি নিজেকে নিজেই সরিয়ে নিয়েছিলেন। কেননা, ২০১৪ এর নির্বাচনে সম্ভবত তিনিই হতেন সর্বশেষ অবসর নেওয়া প্রধান বিচারপতি।
১০. বিচারপতি হক স্বীকার করেছেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বচনের বিধানও সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো। তবে সুন্দর নির্বাচনের জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে একনায়কতন্ত্র আনা যাবে না। অন্যথায়, তাঁর মতে “ইহা হইবে সাংবিধানিক হারাকিরি” (প্যারা ৯৯৯)।
খায়রুল হক সম্পর্কে কয়েকটি মিথ
১. সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরির মতামতকে তিনি উপেক্ষা করেছেন: এমিকাস কিউরিগণ পক্ষ বা বিপক্ষের উকিল নন। তাঁরা আদালতকে আলোকিত করেন। তাঁদের মতামত আদালতের উপর বাধ্যকরী নয়। তাছাড়া আমি উপরে দেখিয়েছি যে, এক দু’জন বাদে বাকি এমিকাস কিউরিরা আদালতে যে সাবমিশন রেখেছেন, সেসব থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়না। বিচারপতি হক প্রায় সব মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। আদালতের সামনে বিচার্য ছিল যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী যেরূপে আছে, সেরূপে সংবিধানসম্মত কিনা। সকলের মতামতের ভিত্তিতেই তিনি বলেছেন যে, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান রেখে করা সংশোধনীটি অসাংবিধানিক। সেটাই সঙ্গত।
২. তিনি সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে মূল আদেশে গিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন: মৌলিক পরিবর্তন না হলে, সারসংক্ষেপ আদেশের থেকে পূর্ণাঙ্গ রায়ে কিছু পরবিবর্তন আসা স্বাভাবিক। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে মূলত সাব্যস্ত (ratio decidendi) হয়েছে যে, উক্ত সংশোধনীটি বেআইনি। চূড়ান্ত রায়েও ওই একই কথা আছে। রায়ের আগেই পার্লামেন্ট এই ব্যবস্থা বাতিল করায়, তাঁর চূড়ান্ত রায়ে আরও দুটি নির্বাচন হওয়ার প্রশ্নে ভাষিক দৃঢ়তার অভাব ঘটেছে (obiter dicta)।
৩. অবসরের পরে তিনি রায় লিখে অন্যায় করেছেন: অবসর নেওয়ার পর বিদায়ী বিচারপতির হাতে যে সকল নিস্পত্তি হয়ে যাওয়া মামলার রায় পাওনা থাকে তা তিনি অবসর নেবার যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে লিখে জমা দিয়ে দেন। এটা রেওয়াজ। এ নিয়ে ধরাবাঁধা কোনো সময় নেই। ঠিক যে, অবসরের পর বিচারক শপথ দ্বারা তাড়িত থাকেননা। আমার ধারণা, এটি আপেক্ষিক প্রশ্ন।
বিচারক যাতে করে পক্ষপাতদুষ্ট না হন, সেজন্য উচিত হলো খুব কম সময়ের মধ্যে রায় দিয়ে দেওয়া, এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের উচিত এটি দেখোভাল করা । যাতে সন্দেহ মুক্ত থাকা যায়। ত্রয়োদশ মামলা নিস্পত্তি হওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পার্লামেন্ট বাতিল করে দেয়। সম্ভবত এই কারণে তিনি দ্রুত রায় লেখার তাগিদ হারিয়ে ফেলেন। দেরিতে লিখে তিনি অন্যায় করেননি, তবে পাঁচ/ছয় মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় লিখলে তিনি হয়তো এতো সমালোচিত হতেন না।
৪. তিনি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট রায় দিয়েছেন: সংবিধানকে রাজনীতির বাইরে ভাবা ঠিক নয়। সংবিধান হচ্ছে পরিশ্রুত রাজনৈতিক লেটমোটিফ। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি তো অধিকতর রাজনৈতিক ব্যাপার। সুতরাং, এই ব্যবস্থার পক্ষে বিপক্ষে যে কোনো রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনামুক্ত হবে না। তবে আমি এই লেখায় আগেই দেখিয়েছি যে, বিচারপতি খায়রুল হক যে সকল যুক্তি দিয়েছেন তা শক্তিশালী, নেহায়েত অগ্রাহ্য করার মতো নয়। ২০০৭ সালেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার রাজনৈতিক সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়, ২০১১-তে এসে এই রায়টি ছিল একটি পরিণতি মাত্র।
আসলে বিচারপতি খায়রুল হকের রায় বিএনপিমনাদের কাছে অনাদৃত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ হলো, ইতিপূর্বে, পঞ্চম সংশোধনী মামলায় (হাইকোর্ট বিভাগ, ২০০৫) বিচারপতি খায়রুল হক খুব যথার্থভাবেই জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা দখল নিয়ে মন্তব্য করেন যে, আগেরকালে বাংলাদেশ বিদেশি বিজেতাদের দখলে শাসিত হলেও স্বাধীন দেশে বাংলাভাষী সামরিক জেনারেলদের দ্বারা বাংলাদেশ দখল হয়ে গেলো। জেনারেল জিয়া সংবিধানকে সামরিক ফরমানের অধীনস্ত করেন। সেই থেকে ব্যুৎপত্তিগতভাবে “সামরিক আইনকে” আইন ভাবার যে ভ্রান্তি বিলাস বিএনপির মধ্যে রয়েছে, বিচারপতি খায়রুল হক সেই ভ্রান্তি বিলাসে চিড় ধরিয়েছেন। এজন্য বিএনপি আগে থেকেই তাঁর উপর অন্যায্যভাবে তেতে ছিল।
দ্বিতীয়ত, ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ মামলায় (২০০৯) বিচারপতি হক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বরাত দিয়ে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এখানেও বিএনপিমনা মানুষ যে পুঁজি নিয়ে রাজনীতির বাজারে বিরাজ করেন, সেই পুঁজিতে চপেটাঘাত করেছেন বিচারপতি হক। সুতরাং, বিএনপি তাঁকে সুযোগ পেলেই বিতর্কিত করবে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল। বিএনপি রুষ্ট হয়েছে বিধায়ই তত্ত্বাবধায়ক মামলার রায়ে তাঁর রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রতিফলিত হয়েছে তা বলার সুযোগ নেই।
বিচারপতি এমএ ওয়াহ্হাব মিয়া:
১. এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া আব্রাহাম লিঙ্কনের বিপরীতে উইনস্টন চার্চিলের মুরিদত্ব নিয়েছেন। তিনি বলছেন যে, গণতন্ত্র শুধু “বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল” না। এর বেশি কিছু। এরপরে তিনি দারুণ একটা কথা বলেছেন, “ডেমোক্রেসি ইজ প্রবাবলি দ্য মোস্ট ইমোশনালি প্রভোকেটিভ টার্ম ইন দ্য পলিটিকাল ভোকাবুলারি। এটা যেমন সরকারের ধরণ আবার একসাথে বসবাস করার একটি দর্শনও।” সুতরাং একটা ভালো নির্বাচন করে সবাইকে আমলে নিয়ে চলার মতো ক্ষমতা রাজনৈতিক সিস্টেমের থাকতে হবে। কেয়ারটেকার সরকার হওয়াতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে। তিনি চার্চিলের বিখ্যাত “লিটলম্যান” উক্তির উপর ভর করতে চেয়েছেন।
চার্চিল ১৯৪৪ সালে পার্লামেন্টে দেয়া বক্তব্যে বলেন যে, গণতন্ত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা পাবে পেন্সিল হাতে বুথগামী ছোট্ট লোকটি, যে ব্যালটের উপর একটি চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে। পরিবর্তনের আশায়। কোনো জ্ঞানগর্ভ বিশাল আলোচনা করে এই লিটলম্যানের গুরুত্ব উপেক্ষা করা চলেনা। আসলে গণতন্ত্রের গোড়ায় রয়েছে ভোট দেবার স্বাধীনতা। জাস্টিস এম এ ওয়াহ্হাব মিয়ার এই যুক্তিটি অত্যন্ত শক্তিশালী। এ যুক্তিকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।
তবে একটি কথা। চার্চিল দিয়ে আমাদের সংবিধান হবেনা। চার্চিল মেটাফোর ভুল ও ভ্যাকুয়াস কনটেক্সটে ভ্রান্তিকরভাবে ব্যবহার করা হয়। চার্চিল “হোয়াইট সুপ্রেমাসিস্ট” হিসাবে নিন্দিত। ভারতীয়দের তিনি বিস্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুতরাং আর যাই হোক, তাঁর কাছ থেকে গণতন্ত্র না শিখলেও চলে। আর ভোটটা তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেমের মাধ্যমেই কেবল সম্মানিত হয়, সেটা ঠিক নয়। তাহলে চার্চিলের দেশে এই সিস্টেম থাকতো।
দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত-এই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন বিচারপতি এম ওয়াহ্হাব মিয়া। তাঁর মতে, এমনি সাধারণ ক্ষেত্রেও তো নির্বাচনের আগে দিয়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেট প্রতিনিধি চরিত্র হারায়। কারণ, ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্টেমে প্রধানমন্ত্রী তখন রাষ্ট্রপতির অনুরোধে নতুন প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যান। তাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারও অপ্রতিনিধিত্বশীল হলেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করলে ক্ষতি কি? তাছাড়া রাষ্ট্রপতি তো নিৰ্বাচিত স্টেটাস নিয়েই সবার উপরে থাকেন!
বিচারপতি মিয়ার এই যুক্তি মান্য করা কঠিন। প্রথমত কিছুদিন যে কতদিন, আল্লা মালুম। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগ দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিধিত্ব চরিত্র হারাননা। বরং তিনি নিৰ্বাচিত হওয়ার যে সম্মান সেটি পেতেই থাকেন, এবং তাঁকে বিশ্বাস করতে রাষ্ট্রপতির বা জনগণের অসুবিধা হয়না। তাছাড়া, যুদ্ধ সংকটে বা রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থায় পূর্বের পার্লামেন্টকে রাষ্ট্রপতি অনেকটা সাপের বিন বাঁচানোর মতো পুনরুজ্জীবন করতে পারেন। এতে বোঝা যায় আগের সংসদ আসলে মরে না, সুপ্ত থাকে।
অধিকন্ত, আমাদের সংবিধানের প্রণেতারা সংসদীয় ধারাবাহিকতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকার সিনেট থেকে। সিনেট নেভার ডাইস। প্রতি তিন বছর পরপর এক-তৃতীয়াংশ সিনেটর নিবাচিত হয়ে বিদ্যমান সিনেটরদের সাথে যুক্ত হন। বাংলাদেশের সংসদের এই জীবন্ততার ধারণা একটু আলাদা করে নেয়া হয়েছে আর কি।
তিন. বাদীগণের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছিল, ধরা যাক, তাত্ত্বিকভাবে, রাষ্ট্রপতি এক্সট্রিম সিচুয়েশন দেখিয়ে আগের পার্লামেন্ট রিকল করলেন। তাহলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার/দের উপস্থিতিতে সেই রিকল করা সংসদের এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের স্টেটাস কী হবে? এক্ষেত্রে, বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়ার জাজমেন্টে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়না। তবে তিনি, বলেছেন যে, এ ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট এক্সট্রিম সিচুয়েশনে রিভাইভড হয়, সেটা কোনোদিন নাও ঘটতে পারে। তবে বলা যায়, কল্পনার সব সিচুয়েশনে কি হবে, একটি সংবিধানকে তাঁর জবাব দিতে পারতে হয়। কপাল খারাপ হলে, এক্সট্রিম সিচুয়েশন বার বার এসে হাজির হয়!
চার. অন্য দেশের নির্বাচন মডেল আমাদের গ্রহণ করা সাজেনা। এটি সত্যি কথা। নিজস্বতা থাকতেই হয়। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলে না। আমাদের সংবিধানটা কমন ল মডেলের। সুতরাং কমন ল মডেলে যে সিস্টেম সময়োত্তীর্ণ তা গ্রহণ করতে পারাটা একটি জাতিগত সক্ষমতা। এটি একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপার। সেটি তৈরিতে, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দায় রয়েছে। গ্লোবাল কনস্টিটিউশনালিজমে বাইরের পরিবর্তন যেমন খেয়াল রাখতে হয়, আবার উপযুক্ত ক্ষেত্রে নিজস্ব সংবিধানের স্বাজাত্য তুলে ধরতে হয়।
বিচারপতি মিয়া অবশ্য মনে করেন, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণ তিনবার আমল করেছে, তাই প্রতিষ্ঠিত এ নিয়মটি আর অসাংবিধানিক বলার সুযোগ নেই। একটি সিস্টেমের কেবল অপব্যবহার হয়েছে বলেই সেটাকে বেআইনি বলা যায়না। যুক্তিটি খারাপ না। তিনবার মেনে নেবার বিপরীতে বিচারপতি খায়রুল হকের যুক্তিটি উপরে দেখে নিতে পারেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে দিন গেছে আর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়েছে।
পাঁচ. বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া আর একটি যুক্তি দিয়েছেন যে, একটি সম্মানিত ইলেকশনে সম্মানিত থাকা যায়। এটি একটি অকাট্য যুক্তি। এ নিয়ে বোধ হয়, কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ ব্যাপারে মেজরিটি জাজদেরও কোনো দ্বিমত নেই। ভালো নির্বাচন চর্চা করতে হয়। সামরিক শাসন আর সাংবিধানিক ক্যু দিয়ে একটি দেশকে শুরুতেই ১৬ বছর পঙ্গু করে রাখলে সেই চর্চা গোড়ায় বাধাপ্রাপ্ত হয়।
ছয়. বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া মনে করেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সিস্টেম বিচার বিভাগের জন্য “ঝুলন্ত মূলা” না। কোনো প্রধান বিচারপতি উপদেষ্টা হবার জন্যে প্রলুব্ধ হয়েছেন এমনটি হয়নি বলে তাঁর মত। বলাই বাহুল্য, এটি একটি বাস্তবতা বিবর্জিত কথা। তাহলে তিনি মূল বিচার্য বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (কেয়ারটেকার-এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এই মৌলিক কাঠামোর কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা) ধরতেই পারেননি। তাহলে কি জন্য সবাই আদালতে গেলো, আর চারিদিকে এতো উদ্বেগই বা কেন দেখা দিলো? বিচারপতিদের স্বাধীনতার প্রশ্ন, কোনো বিচারক নিজে কোনোভাবে প্রলুন্ধ হয়েছেন কিনা শুধু সেই ব্যাপার নয়, বরং অন্য কেউ তাঁকে/তাঁদেরকে প্রলুব্ধ করতে পারে, এমন যুক্তিসঙ্গত আশংকা আছে কিনা–সেই প্রশ্নও বটে। আশংকা যদি থাকে, তবে তাইই বিচারবিভাগের স্বাধীনতায় আঘাত হানতে যথেষ্ট।
সুতরাং, রায়ের প্রধান দু’টি মতামত তুলনা করলে বিচারপতি খায়রুল হকের রায় শ্রেয়তর যুক্তিপূর্ণ ও ওজনদার মনে হয়। তাহলে, দেখা গেলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে ফরমেটে আগে ছিল সেটি আমাদের সাংবিধানিক যে অভিজ্ঞান, সেই অভিজ্ঞানের ভেতর নেই। আপিল বিভাগ খুব যথার্থভাবেই এই সিস্টেমকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এখন নতুন সময়ের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ নতুন একটি রিটের প্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনীকে আংশিক অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। এর একটি অর্থ হল ১৩-তম সংশোধনীকে বাতিল করা সংসদের ঠিক হয় নাই। হাইকোর্টের এই রায়টি বিচারপতি দেবাশীষ রয় চৌধুরী ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এর দেওয়া। তাঁদেরও কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। রায়টির তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বিচারিক ও আইন বিজ্ঞানের যুক্তি এখনো আমি পড়িনি। সে বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না। তবে মান্নান খান মামলাটি আপিল বিভাগে রিভিউ আকারে রয়েছে। সেই রিভিউ এখনো আইনিভাবে চিন্তার খোরাক আনবে। এখন সাংবিধানিক সংস্কারের আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ফরম্যাট কি হবে তা নির্ধারণ করবার জন্য আওয়ামীলীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন প্রয়োজন। তা না হলে যে সংকট আমাদের জাতীয় জীবনকে অতীতে বারে বারে টেনে ধরেছে, আবারও তাই হবে। তা কী করে জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে?
লেখক: ভিজিটিং প্রফেসর, কোট দ্য জুর ইউনিভার্সিটি, নিস, ফ্রান্স। মতামত ব্যক্তিগত