।।এম আর করিম রেজা।।
বিলেত মানেই যেন সাজানো-গোছানো শহর, লাল বাস, পাথরের বাড়ি, আর নদীর ধারে হাঁটা মানুষ। কিন্তু এই চেনা ছবির আড়ালে এক অদ্ভুত, অথচ মনমুগ্ধকর জীবনযাপনও আছে—জলের ওপর ভাসমান ঘরে থাকা, মানে হাউসবোটে বসবাস । আজকের দিনে যুক্তরাজ্যে অনেক মানুষ এই জীবন বেছে নিয়েছেন। কেন? কীভাবে চলে তাঁদের দিন? চলুন, একটু ডুব দেওয়া যাক এই ভাসমান জীবনের ভেতরে।
🏡 ভাসমান ঘর, স্থির জীবন
বর্তমানে ব্রিটেনে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ স্থায়ীভাবে হাউসবোটে থাকেন। সাধারণত লন্ডন সহ বড় শহরগুলোর নদী ও খালের ওপর এসব হাউসবোটের জীবন। কেউ কেউ থাকেন নদীর ঘাটে, কেউ খালে বাঁধা নৌকায়। একেকটা হাউসবোট মানে একেকটা ছোট্ট, কাঠের, লোহার, কিংবা আধুনিক ফাইবারের তৈরি বাড়ি—ভেতরে রান্নাঘর, বিছানা, টয়লেট সবকিছুই আছে, তবে ছোট পরিসরে। কারও বোটে বইয়ের তাক, কারও খুপরি স্টুডিও, কারও আবার ছাদে ছোট্ট সবজির বাগান!
💸 বাড়িভাড়া থেকে মুক্তি, কিন্তু শিকড় ছেঁড়া নয়
লন্ডনের মতো শহরে ভাড়ায় থাকা কিংবা বাড়ি/ফ্ল্যাট কেনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেখানে অনেকেই হাউসবোটকে বেছে নেন সাশ্রয়ী জীবন কাটানোর উপায় হিসেবে। হাউসবোটে বসবাস মানে—কম কাউন্সিল ট্যাক্স, কম ইউটিলিটি বিল, আর প্রকৃতির আরও কাছাকাছি থাকা। তবে কেউ কেউ শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য নয়, বরং জীবনকে একটু ধীরে, একটু গভীরে দেখতে চান বলেই হাউসবোটে থাকেন।
🌿 নগরের জলের ওপর এক টুকরো গ্রাম
ভাসমান ঘর মানেই যেন শহরের কোলাহলের বাইরে এক টুকরো নিরিবিলি। নদীর ধারে বসে চা খাওয়া, পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা, গরম বিকেলে জলে পা ভিজিয়ে বই পড়া—এই সব মুহূর্তই হাউসবোটবাসীদের জন্য খুব সাধারণ, কিন্তু কারো কাছে অনেকটা রূপকথার মতো।
শহরের খাল ও নদীর ধারে একসাথে বাঁধা থাকে অনেক হাউসবোট। দেখতে দেখতে সেখানে গড়ে ওঠে একধরনের জলভিত্তিক পাড়া-মহল্লা। কারও নৌকার ছাদে সোলার প্যানেল, কারও জানালার পাশে ঝোলানো ফুলের টব, কেউ আবার দুপুরে কাঠ জ্বালিয়ে চা বসান, আর পাশের বোট থেকে গন্ধে টেনে আনে ভাজা পিয়াঁজের গন্ধ।
পাড়া মহল্লার মতো করে পাশের নৌকার মানুষদের চেনা, মাঝেমধ্যে নৌকায় দাওয়াত, কিংবা কেউ অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো—সব মিলিয়ে একধরনের ভাসমান পাড়া যেন।
🎶 জীবনের ছন্দ, একটু আলাদা
এই ভাসমান পাড়ায় শিশুরাও বড় হয় নদীর সঙ্গে, জল, গন্ধ আর আলো-ছায়ার সঙ্গে। সন্ধ্যায় কেউ গিটার বাজায়, কেউ বই পড়ে। নৌকা দুলে দুলে একটা ছন্দ তোলে, যা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় পাওয়া যায় না।
আর ছুটির দিনগুলো?
ওই দিনগুলো যেন ছোটখাটো উৎসব! কেউ নৌকার ছাদে জড়ো করে বন্ধুদের, কেউ খালের পাশে টেবিল পেতে চা আর কেক সাজায়। কেউ বারবিকিউ করে, কারও বোটে বাজে জ্যাজ স্যাক্সোফোন।
গান, আলো আর কথার ভাঁজে একেকটা ছুটির সন্ধ্যা কেটে যায় নিখুঁত আনন্দে। কেউ নতুন কাউকে নিয়ে আসে, কেউ পুরনো বন্ধুকে নিয়ে ফিরে আসে পুরনো গল্পে।
এটা শহরের বাইরের জীবন নয়—এটা শহরের ভেতরের সেই প্রাণ, যা কখনো হারিয়ে যায় না, বরং জলে ভেসে ঘুরে ফিরে বেড়ায়।
🔧 স্বাধীনতা, কিন্তু দায়িত্ব নিয়েও
হাউসবোটে থাকা মানে স্বাধীনতা—কিন্তু সেটা আবার দায়িত্ব নিয়েও। বোট নিজেরই চালাতে হয়, পানির ট্যাঙ্ক পূরণ, সৌর প্যানেল লাগানো, বর্জ্য নিষ্কাশন ইত্যাদি কাজ নিজের হাতে করতে হয়। এতে একরকম আত্মনির্ভর জীবনধারা তৈরি হয়।
তবে সমস্যা-সুবিধা পাশাপাশি থাকে—শীতকালে ঠান্ডা বেশি লাগে, বরফ পড়লে পানি জমে, জায়গা কম, যোগাযোগের ঠিকানা সহজ নয়, আর নৌকায় কাজ না জানলে শুরুতে ঝামেলাও কম নয়।
🧭 কেন মানুষ এই জীবন বেছে নেয়?
👉 কেউ দারিদ্র্য এড়াতে, টাকা বাঁচাতে
👉 কেউ প্রকৃতির কাছে থাকতে
👉 কেউ শহরের নিয়মের বাইরে বেরোতে
👉 কেউ একঘেয়ে জীবন থেকে পালাতে
👉 আর কেউ কেউ এই জীবনকে ভালোবেসে, হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে
⚓ বিলেতের হাউসবোট জীবন শুধু একটা “বিকল্প বসবাস” নয়—এটা একধরনের জীবনদর্শন। যেখানে মানুষ ছোট পরিসরে, কিন্তু বড় মনের সঙ্গে বাঁচে। যেখানে স্থায়ী ঠিকানা নেই, কিন্তু আকাশের নিচে মুক্ত শ্বাস আছে। খুঁটিনাটি দায়িত্ব আছে, কিন্তু তার মাঝেই স্বাধীনতার স্বাদ।
এই জীবন হয়তো সবার জন্য নয়, কিন্তু যারা এই পথ বেছে নেয়—তারা জানে, ঘর মানেই চারটে দেয়াল না, ঘর মানে নিজের মতো করে বাঁচার জায়গা। আর সে ঘর যদি জলে ভাসে, তাতেই বা ক্ষতি কী?