ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নীলিমা আকতারকে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি গোপালগঞ্জে হত্যাকাণ্ড, ৫ আগস্টের পর সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৩০০ সৈনিক হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে মব-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লিখিত বিবৃতি দেওয়ার পর তিনি জামাত-বিএনপি ও ছাত্র শিবিরের সমর্থিত গোষ্ঠীর ক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপরও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
ড. নীলিমা আকতার, যিনি আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত এবং ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে নীল দলের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন, সম্প্রতি ফেসবুকে একাধিক পোস্টে ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি গোপালগঞ্জে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, ৫ আগস্টের পর থেকে সংঘটিত সহিংসতা এবং ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৩০০ সৈনিক হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের জবাবদিহিতা দাবি করেন।
এছাড়া, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত-শিবির সমর্থিত গোষ্ঠীর মব-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লিখিত বিবৃতি দেন, যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এক্স প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত পোস্টে দাবি করা হয়, নীলিমা আকতারের এই প্রতিবাদের জেরে জামাত-শিবির ও ছাত্রী সংগঠনের সদস্যরা তাঁর বিরুদ্ধে মব সৃষ্টির পরিকল্পনা করে। একটি পোস্টে বলা হয়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নীলিমা আকতার দৃঢ় কণ্ঠে সত্য বলার জন্য বিপদের মুখোমুখি। শিবির ও ছাত্রী সংস্থার স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি কর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে মব সৃষ্টির চেষ্টা করছে।”
ড. নীলিমার প্রতিবাদ অব্যাহত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, যাকে কেউ কেউ জামাতপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছেন, তাঁকে সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। এই ঘটনার সাথে লালমনিরহাটের ম্যাজিস্ট্রেট উর্মি রায়ের অব্যাহতির তুলনা করা হচ্ছে, যিনি একই ধরনের রাজনৈতিক কারণে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি, তবে সামাজিক মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তকে “প্রতিহিংসামূলক” হিসেবে সমালোচনা করা হচ্ছে।
নীলিমা আকতারের অবস্থান
৫ আগস্টের পর, যখন অনেক শিক্ষক নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চুপ থেকেছেন, ড. নীলিমা আকতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত-শিবিরের প্রভাব এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কথা বলে গেছেন, যা তাঁর চাকরিচ্যুতির অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সমর্থকরা বলছেন, “বিপদ জেনেও তিনি চুপ থাকেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং আদর্শিক শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলে আজ শাস্তি পেয়েছেন।”
ড. নীলিমার চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, “এটি ড. ইউনুসের সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এজেন্ডার অংশ। নীলিমা ম্যামের মতো সৎ ও সাহসী শিক্ষকদের নিশানা করা হচ্ছে।” এদিকে, বিএনপি ও জামাত সমর্থিত গোষ্ঠী এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব এবং মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছে।
এই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন ও সমালোচনা দেখা দিয়েছে। সমর্থকরা ড. নীলিমার পুনর্বহাল এবং তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব এবং শিক্ষকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর নতুন করে আলোকপাত করেছে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ এই বিষয়ে জনমতকে প্রভাবিত করবে।