টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র বিরুদ্ধে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক রাজনৈতিক সমাবেশে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে আজ বুধবার মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এই ঘটনা টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এনসিপির এই কর্মকাণ্ডকে শিক্ষার পরিবেশ নষ্টকারী এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
২৯ জুলাই এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়। খবরে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলাকালীন সময়ে বের করে এনসিপির পথসভায় অংশগ্রহণ করানো হয়, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বিস্তারিতঃ স্কুল চলাকালে শিক্ষার্থীদের সমাবেশে নিতে এনসিপি নেতাদের বলপ্রয়োগ, বাধ্য হয়ে ছুটি ঘোষণা
বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন দশম শ্রেণির ছাত্রী বলেন, “আমরা ক্লাস করছিলাম, হঠাৎ কিছু লোক এসে আমাদের বললো বাইরে যেতে। আমরা ভয় পেয়েছিলাম, কারণ আমাদের শিক্ষক বা অভিভাবকদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের শিক্ষার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।” একইভাবে, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী জানান, “আমাদের জোর করে সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে আমরা কিছুই বুঝিনি। আমরা শুধু পড়াশোনা করতে চাই।”
আজ সকালে শহীদ মিনারের সামনে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শতাধিক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক মানববন্ধনে অংশ নেন। তারা ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করো’, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করো’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার প্রদর্শন করেন।
মানববন্ধনে বক্তারা এনসিপির এই আচরণকে শিক্ষার অধিকারের ওপর আঘাত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা খর্বকারী হিসেবে সমালোচনা করেন। বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নিগার সুলতানা বলেন, “শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জড়ানো একটি অপরাধমূলক কাজ। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং প্রশাসনের কাছে এর তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।” একইভাবে, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল করিম বলেন, “আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আমাদের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার পরিবেশকে ধ্বংস করে। আমরা এর পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর পদক্ষেপ চাই।”
২৯ জুলাই এনসিপির ‘জুলাই পদযাত্রা’র অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলে পদযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ লোকের সমাগম হবে বলে দলটি আশা প্রকাশ করেছিল। সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য ৯০০-এর বেশি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল, যার মধ্যে এপিবিএন পুলিশের ৭০ জন সদস্যও ছিলেন। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং মুখ্য সমন্বয়কারী নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীসহ দলের শীর্ষ নেতারা এই সমাবেশে অংশ নেন।
টাঙ্গাইল জেলা এনসিপির একজন নেতা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমাদের সমাবেশে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ছিল। আমরা কাউকে জোরপূর্বক নিয়ে যাইনি। এই অভিযোগ আমাদের দলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ।” তবে, তিনি এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ বা বিবৃতি প্রকাশ করেননি।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহিনুর রহমান জানান, “আমরা এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে, তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
এই ঘটনা স্থানীয় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এনসিপির বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ এবং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোষ্টে বলা হয়, “এনসিপির এই আচরণ শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।”
অন্যদিকে, কেউ কেউ এই প্রতিবাদকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ বলে মনে করছেন। তবে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
বিন্দুবাসিনী স্কুলের ঐতিহ্য
বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৮২ সালে এবং বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুটি বিদ্যালয় টাঙ্গাইলের শিক্ষাক্ষেত্রে গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ২,০০০ শিক্ষার্থী এবং ৫৫ জন শিক্ষক রয়েছেন, এবং এটি বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় শিক্ষা প্রদান করে। বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের খেতাব অর্জন করে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বোর্ড পরীক্ষায় সর্বাধিক ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ বৃত্তি অর্জন করে আসছে।
বিন্দুবাসিনী স্কুলের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ক্ষোভের প্রকাশ। এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার অধিকার রক্ষায় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। তদন্তের ফলাফল এবং প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।