।। মাহতাব আহমেদ।।
“আমার দাদা ছিলেন চৌধুরী, আমি আবার কাঠমিস্ত্রি হই?”, এটাই আমাদের সেই চিরাচরিত বাঙালি মনোভাব, যেখানে হাতের কাজ, চাকরি মানে তেল-মাটি-ঘাম, সেটা যেন সামাজিক পতনের নামান্তর। ভুলে যাই, আমাদের বেশিরভাগ পূর্বপুরুষই ছিলেন গর্বিত কৃষক, নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে, ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর এখন? ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে পাইপ ঠিক করাটা যেন পারিবারিক গাছের গোড়া কেটে দেওয়া! একজন প্লাম্বার মাস্টার্সধারীর চেয়ে বেশি আয় করছেন, এ তো সমাজে মহাপাপ! আমাদের এখানে চাকরির মান নির্ধারণ হয় না দক্ষতা বা উপার্জনে, বরং হয় সেই কল্পিত পুরনো পূর্বপুরুষদের মুখভঙ্গিতে, যাঁরা স্বর্গে বসে চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন, বিচারকের ভূমিকায়!
বাংলাদেশে শেখার প্রতি উৎসাহ আসে তখনই, যখন শেখার পেছনে টাকা লুকিয়ে থাকে। কেউ যদি বলে “ফ্রিল্যান্সিং শিখে লাখ টাকা আয় করুন” বা “এই কোর্স করলেই BCS”, তখনই মানুষের মধ্যে এক ধরণের তুফান ওঠে। কিন্তু যখন বলা হয়, “দাদা, স্কিল শেখো, নিজেকে গড়ো, ধৈর্য ধরো”, তখন উত্তর আসে, “এইটা পরে করবো, আগে একটু রিল দেখি।” এমনকি ইংরেজি মিডিয়ামের সন্তান, যারা ‘CEO মেটেরিয়াল’ হয়ে জন্মেছে, তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ে, যদি ফলাফল হয় দ্রুত আয়। কিন্তু যদি বলা হয় ‘ধীরে ধীরে বড় হও’, তারা এক কদমও এগোয় না।
সম্প্রতি, আমার একটি প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে TAFE–কে বাংলাদেশে আনার জন্য। হ্যাঁ, সেই TAFE, যেটাকে আমরা অনেকেই হালকাভাবে দেখি, কফি খেতে খেতে যেটার নাম শুনে একটু নাক সিঁটকাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি—তাদের সাবমেরিন প্ল্যান্টের জন্য ২০ হাজার ওয়েল্ডার দরকার। শুধু ওয়েল্ডিং জানলেই হবে না, ইংরেজিও জানতে হবে। সাবমেরিনের ভাষা, দেখা যাচ্ছে, ভুল গ্রামার সহ্য করে না! ভাবলাম, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বলি। কিন্তু না, সেখানেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ছাত্ররা তো দূরের কথা, তাদের অভিভাবকরাই বলে ওঠে, “আমার সন্তান ওয়েল্ডার? তারপর কে তাকে বিয়ে করবে?”
অথচ অস্ট্রেলিয়ার ৯ নিউজের প্রতিবেদনে দেখা যায়, Rope-access technician, miner, construction worker, drill rig operator, এই পেশাগুলোতে বছরে ৯০,০০০ থেকে ১,৭০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার আয় হয়। কোনো চার বছরের ডিগ্রি লাগে না, লাগে কয়েক মাসের দক্ষতা আর সঠিক প্রশিক্ষণ। TAFE এই পথ খুলে দিয়েছে, দ্রুতগতির, বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ, যেটা সরাসরি চাকরির বাজারে নিয়ে যায়। এখন তো অবস্থা এমন, অনেক ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস গ্র্যাজুয়েটদের চেয়েও বেশি আয় করছে।
অস্ট্রেলিয়া বা উন্নত দেশগুলোতে সম্মান আর উপার্জনের ভিত্তি হলো দক্ষতা, চাকরির টাইটেল নয়। আর আমরা? এখনো ডিগ্রির পালিশ ঘষে যাচ্ছি, চোখ বন্ধ করে বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলছি। AI যখন বেসিক কাজগুলো সরিয়ে দিচ্ছে, তখন বড় বড় কর্পোরেটগুলো নতুন গ্র্যাজুয়েট নিয়োগই কমিয়ে ফেলছে। অন্যদিকে, নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তিখাতে দক্ষ মানুষের অভাব। একজন LinkedIn এক্সপার্ট দশমবার তার হেডলাইন ঠিক করছে, আর এক প্লাম্বার ইতিমধ্যেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত, হ্যাশট্যাগের সময়ই নেই।
বাংলাদেশের সামনে এখন সুযোগ আছে। Industry 4.0 আমাদের দরজায়। দক্ষ পেশাজীবীদের চাহিদা – ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, সোলার টেকনিশিয়ান, রেফ্রিজারেশন মেকানিক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কুক, শুধু বাড়বে। দরকার সম্মান দেওয়া, আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা, আর ‘কাজের লোক’ (servant) কথাটাকে রূপান্তর করা, ‘স্পেশালিস্ট’-এ।
এখন ২০২৫। এখনো যদি বিশ্বাস করি যে সম্মান শুধু রিভলভিং চেয়ারে আর টাই ক্লিপে বন্দি, তাহলে আমরা আরেকটা “ডিগ্রিধারী বেকার” প্রজন্ম তৈরি করবো। আমাদের দরকার আরেকটা এমবিএ না, দরকার একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি, কোড ওয়েল্ডার আর সোলার ইঞ্জিনিয়ার। প্রশ্নটা বদলানো উচিত, “আপনার ডিগ্রি কী?” থেকে “আপনি কি কাজটা পারেন?”
কারণ এখনো বাংলাদেশে কাঠমিস্ত্রি হওয়াটা শুধু সমাজে নয়, বিয়ের বাজারেও রিস্ক ফ্যাক্টর। অথচ যাঁরা ‘কাজের লোক’ বলে অবহেলা করি, উন্নত দেশে তারাই CEO-এর সমান বেতন পান। আমরা ডিগ্রির মোহে পড়ে আছি, হাতে কাজ নেই, তবুও আত্মসম্মানে ভরপুর। AI আমাদের পেছনে ফেলে যাচ্ছে, আর স্কিলভিত্তিক পেশাজীবীরা এগিয়ে যাচ্ছে। সময় এসেছে—অহংকার নামিয়ে, হাতে তুলে নেওয়ার একগুচ্ছ টুল। আর জিজ্ঞেস করার সময়, “ডিগ্রি আছে?” নয়, “কাজটা পারো তো?”