যুক্তরাজ্য গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধ ও টেকসই শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আগামী সেপ্টেম্বর মাসেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে এক সরকারি বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের আগেই যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে। তবে এজন্য শর্ত হিসেবে ইসরায়েলকে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, অধিকৃত পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথে এগোতে হবে।
স্টারমার বলেন, ‘ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কোনো সমতুল্যতা নেই। হামাসকে অবশ্যই সকল জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে, অস্ত্র পরিহার করতে হবে এবং গাজার প্রশাসনে তাদের কোনো ভূমিকাই থাকবে না—এই দাবিগুলো আমরা আগের মতোই জোর দিয়ে জানাচ্ছি।’
বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন একটি খসড়া শান্তি উদ্যোগ ও গাজায় বাড়তি মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়েও আলোচনা হয়। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের কোনো সরকার নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে এমনভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির কথা বলেনি। তাই স্টারমারের এই ঘোষণাকে যুক্তরাজ্যের নীতিগত অবস্থানে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ঘোষণার কড়া সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে একে ‘হামাসকে পুরস্কার দেওয়া’ বলে উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এতে গাজায় যুদ্ধ শেষ করার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নতুন করে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাও ধ্বংস হয়ে যাবে। উল্লেখযোগ্য, সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি মার্চে ইসরায়েলই ভেঙে দিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হুসাম জোমলট বলেন, যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি একটি ‘ঐতিহাসিক ও নৈতিক গুরুত্ব’ বহন করে। তিনি বলেন, এটি উপনিবেশিক যুগের বেলফোর ঘোষণার অন্যায়ের প্রতিকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই স্বীকৃতি অবশ্যই ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে একটি বড় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হতে হবে। একইসঙ্গে গাজায় গণহত্যা বন্ধ, পুনর্গঠন এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
লেবার পার্টির অর্ধেকের বেশি ব্যাকবেঞ্চ এমপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাদের মতে, এটাই ইসরায়েলকে শান্তির পথে বাধ্য করার একটি কৌশল হতে পারে।
স্টারমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘গাজার সহ্য-অযোগ্য পরিস্থিতি ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান আরও অধরা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করেছে। এটি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকেই এগিয়ে নেবে।’ তিনি জানান, ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে যুক্তরাজ্য একটি আট দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে এবং এই স্বীকৃতি সেই প্রক্রিয়ার অংশ।
এর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দেন, ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। ইউরোপের বড় দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সই হবে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র, যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। এরই মধ্যে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
লেবার এমপি ও চিঠির আয়োজক সারাহ চ্যাম্পিয়ন বলেন, ‘ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আদর্শ সময় হয়তো কখনো আসবে না। কিন্তু এটি হতে পারে শেষ সুযোগ—যদি আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি ফিলিস্তিনিদের স্বীকৃতির অধিকার রয়েছে।’
আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, স্টারমার ও ম্যাক্রোঁ—দুজনই গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে কার্যত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু উচ্চাশার কথা বললে হবে না, তাদের কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে তারা এক অর্থে গণহত্যার অংশীদার হয়ে থাকবেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, তারা ঠিক কোন ধরনের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন—শুধু পশ্চিম তীরের ১০ শতাংশ অংশকে, নাকি ১৯৬৭ সালে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমসহ পুরো ভূখণ্ডকে নিয়ে একটি সার্বভৌম ও সংযুক্ত রাষ্ট্র?